নিউজ ডেস্কঃ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনার তাণ্ডবে দিশেহারা মানুষ। ভয়ংকর রূপ নেয়া এ ভাইরাসের লাগাম কিছুতেই টানা যাচ্ছে না। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে শত শত নাম। বাংলাদেশেও এ ভাইরাস মহামারি রূপ নিয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, সংক্রমণ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে ভাইরাসটি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে দেশে দেশে গবেষকরা এরই মধ্যে পরীক্ষাগারে করোনার টিকা তৈরি করছেন এবং সেগুলো বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে পরীক্ষা করতে শুরু করেছেন। যদি ইতিবাচক ফল পান, তাহলে এ বছরের শেষের দিকে মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা যেতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
এরই মধ্যে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক করোনার ভ্যাকসিন তৈরির দাবি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আগামী ডিসেম্বরে করোনার টিকা বাজারে আনতে চেয়েছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলছেন, বাংলাদেশের মতো কম উন্নত (এলডিসি) একটি দেশে কোভিড-১৯’র ভ্যাকসিন তৈরি একটি বিশাল ব্যাপার।
জানা গেছে, ড. খন্দকার মেহেদী আকরাম একজন বায়োমেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট। ভ্যাকসিন তৈরির সাথে তিনি সরাসরি যুক্ত না থাকলেও মলিকুলার বায়োলজি, ক্লোনিং, ভাইরাল ট্রান্সডাকশন, ভাইরাল রিকম্বিনেশন, অ্যানিমল মডেলিং, জিন সিকুয়েন্সিংয়ের মতো কাজের সাথে জড়িত।
আরও পড়ুন: করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীর গোপন চিঠি ফাঁস
এর আগে, গ্লোব বায়োটেক বলেছে এ পর্যন্ত তারা ভ্যাক্সিনের টার্গেট ডিজাইন করেছে এবং খরগোশের শরীরে পরীক্ষা করে সফল হয়েছে। এখন তারা ভ্যাক্সিন টার্গেটগুলো পরীক্ষা করবে ইঁদুরের ওপর। গ্লোব বায়োটেক দাবি করেছে তারা সামনের ডিসেম্বরেই বাজারে ভ্যাক্সিন নিয়ে আসবে।
ভ্যাকসিন কীভাবে তৈরি হয়-এমন প্রশ্নে মেহেদী আকরাম বলেন, ভ্যাকসিন তৈরির চারটি ধাপ। প্রথম ধাপে টার্গেট নির্বাচন করা হয়। এ ধাপে- ইন-সিলিকো টার্গেট অ্যানালাইসিস করতে হয়। সফটওয়্যারের মাধ্যমে এটা এক ধরনের ড্যাটা বেইজ অ্যানালাইসিস (বায়োইনফরমেটিকস)। জানুয়ারি থেকে করোনাভাইরাসের হোল জিনোম সিকুয়েন্স হয়েছে অনেক। সব সিকুয়েন্স ড্যাটা উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে এনসিবিআই ওয়েবসাইটে যাতে করে বিজ্ঞানীরা করোনার ওষুধ বা ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে।
তিনি বলেন, ভ্যাকসিন তৈরির প্রাথমিক ধাপ হলো হোল জিনোম সিকুয়েন্স থেকে করোনাভাইরাসের জিনের একটি বা কয়েকটি ছোট্ট অংশ বা টার্গেট নির্বাচন করে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরি করা। অক্সফোর্ড এবং চীনে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন উৎপাদনকারী জিন সিকুয়েন্সকে টার্গেট করে ভ্যাকসিন তৈরি করছে। যদিও গ্লোব বায়োটেক পরিষ্কারভাবে এখনো বলেনি ওদের টার্গেট কোনটা, শুধু বলেছে তাদের প্রাথমিক টার্গেট ৪টি। গ্লোব বায়োটেকের প্রেস ব্রিফিংয়ে দেয়া তথ্য অনুযায়ী তারা এ ধাপ সম্পন্ন করেছে। এরপর ভাইরাল ভেক্টর প্রিপারেশনের জন্য ল্যাবরেটরি কার্যক্রমের পালা।
কোন ধরনের ভ্যাকসিন গ্লোব বায়োটেক আবিষ্কার করেছে, তা কিন্তু বলেনি। এর উত্তরে ড. মেহেদী আকরাম বলেন, ধরে নিলাম, গ্লোব অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর বেইজড ভ্যাকসিন তৈরি করছে। অক্সফোর্ড এবং চীন অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর বেইজড ভ্যাকসিন তৈরি করছে। অ্যাডিনোভাইরাস হলো এক ধরনের নন-এনভেলপড ডিএনএ ভাইরাস। এর সংক্রমণে মানুষের সাধারণ সর্দি-জ্বর হয়। এই পদ্ধতিতে প্রথমে অ্যাডিনোভাইরাস থেকে কয়েকটি জিন সরিয়ে ফেলা হয় (ই১ এবং ই৩ জিন) যাতে করে ভাইরাসটি শুধু সংক্রমণ করতে পারবে কিন্তু বংশবিস্তার করতে পারবে না। এই পরিবর্তিত অ্যাডিনোভাইরাসটি কাজ করে ভ্যাক্সিনের ডেলিভারি ভেক্টর বা বাহক হিসেবে। অন্য দিকে ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমিড ডিএনএ ব্যবহার করে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয় পূর্বনির্বাচিত টার্গেট জিনের ডিএনএ কপি।
আরও পড়ুন: করোনায় বাংলাদেশে নতুন রোগ শনাক্ত
এরপর একটা বিশেষ পদ্ধতিতে সেল কালচারের মাধ্যমে এই টার্গেট ডিএনএ যেমন স্পাইক প্রোটিন জিন প্রবেশ করানো হয় অ্যাডিনোভাইরাসের ভেতর। এভাবে তৈরি করা রিকম্বিনেন্ট অ্যাডিনোভাইরাসটি কোনো কোষকে সংক্রমিত করলেও তা ওই কোষের ভেতরে তৈরি করে করোনাভাইরাসের মতো স্পাইক প্রোটিন। অর্থাৎ এই রূপান্তরিত অ্যাডিনোভাইরাসটি তখন এক ধরনের নকল করোনাভাইরাসের মতো রূপ প্রদর্শন করে কিন্তু কোভিড রোগ তৈরি করতে পারে না। এই রূপান্তরিত অ্যাডিনোভাইরাসটিই ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলেও জানান তিনি।
গ্লোব বায়োটেকের দাবি অনুযায়ী, তারা কাজ শুরু করেছে মার্চের প্রথম থেকে। সে অনুযায়ী যদি তারা এই ভ্যাক্সিন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করে তাহলে তারা প্রথম ধাপটি শেষ করে থাকবে মে মাসের মধ্যেই। এর পরের ধাপটি হলো ভ্যালিডেশন।
এর আগে, গ্লোব বায়োটেকের ড. আসিফ জানিয়ে ছিলেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছর বিজয়ের মাসেই করোনার ভ্যাকসিন সবার কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে।
নিজেদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে পরবর্তী ধাপেও সফল হতে শতভাগ আশাবাদী প্রতিষ্ঠানটির তরুণ তুর্কি ড. আসিফ। তবে যেকোনো পরিস্থিতি বিবেচনায় প্লান বি,সি কিংবা ডি প্রস্তুত আছে তাদের। তাই সরকারি সহায়তা পেলে সামনে আর বাধা দেখছেন না তারা।
৮ মার্চ স্বপ্ন বুনেছিলেন নিজেরা। ছিল আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় মনোবল। সেই স্বপ্নের সারথী এখন কোটি বাঙালি, বলছিলেন ড. আসিফ। তিনি বলেন, অপেক্ষাটা আর কয়েক সপ্তাহ, তারপরেই মানবদেহে ট্রায়াল। দুই এ দুই এ চার মিলে গেলে আসছে ডিসেম্বরে অর্থাৎ বিজয়ের মাসেই বাজারে আসবে দেশে উদ্ভাবিত প্রথম করোনা ভ্যাকসিন।
আরও পড়ুন: দেশে আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় সংক্রমণের ভয়ংকর শঙ্কা
ড. আসিফ মাহমুদ বলেন, আমরা একটা হিসাব করে দেখেছি, যদি সবকিছু ঠিক থাকে পশুর উপর ভ্যাকসিন প্রয়োগের অ্যাপ্রুভালটা যদি ঠিকমতো সময় পাই তাহলে অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বরে ট্রায়ালের জন্য আমরা হাতে সময় রাখছি। আশা করছি, বিজয়ের মাসেই বাজারে করোনা ভ্যকসিন নিয়ে আসতে পারবো। তবে এর জন্য ড্রাগস বাজারে ছাড়ার অ্যাপ্রুভাল লাগবে।
ড. আসিফের চোখে এখন স্বপ্ন দেখছে গোটা বাংলাদেশ। এই প্রত্যাশা চাপ নয়, বরং সহায়ক মানছেন তারা। বলছেন, দরকার একটু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। বাকিটা, চোখের সামনে সাফল্য ছাড়া কিছুই দেখছেন না তারা।
তিনি বলেন, আগে শুধু এটা আমাদের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখন এটা দেশের স্বপ্ন। সকলের প্রত্যাশার জায়গা দেখে নতুন উদ্যোমে আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি।
অদম্য এই যাত্রায় সবাইকে পাশে চাইছেন স্বপ্নবাজ ড. আসিফ মাহমুদ।