এক কথায় বাংলাদেশের সকল তথ্য উপাত্তই গোঁজামিল দেওয়া। কারো সাথে কারো তো মিলবেই না এমনকী একই বিষয়ে বিভিন্ন ভিন্ন সংস্থা তথ্য সংগ্রহ করলে আরো ভয়াবহ অবস্থার প্রকাশ ঘটবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যা হবে তার সাথে এনজিওদেও তথ্য কোন ভাবেই মিলবেনা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার ১৪ শতাংশ। এটিকে তারা মাইলফলক বলছে। একই সঙ্গে আগামী দিনের পরিকল্পনাও নির্ধারণ করেছে। ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তারা। কিন্তু কারিগরির বর্তমান শিক্ষার্থীর হার নিয়েই শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ্য করা গেছে। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধান, আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা ও সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাস্তবে কারিগরিতে শিক্ষার্থীর হার ৮.৪৪ শতাংশ। বলা যেতে পারে এই লক্ষমাত্রা কোনভাবেই পুরণ হবার নয়।
কারিগরি শিক্ষায় শুধু শিক্ষার্থীর তথ্যই নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই চলছে ব্যাপক সংকট। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় এগোতে পারছে না কারিগরি শিক্ষা। সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোকে মডেল হিসেবে ধরে এগোনোর চেষ্টা করলেও সেখানে শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবরেটরি, শিক্ষক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এক শিফটের শিক্ষক দিয়ে চালানো হচ্ছে দুই শিফট। এমনকি সরকারি পলিটেকনিকে আগামী ১ অক্টোবর থেকে দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস না চালানোর হুমকি দিয়ে রেখেছেন শিক্ষকরা। এতে বড় সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বেসরকারি পলিটেকনিকের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ৩৮৭ বেসরকারি পলিটেকনিকের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ২৫টি ছাড়া অন্যগুলো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শুধু নাম সর্বস্ব বললে খুবই কম বলা হবে। এককথায় বলতে গেলে, মালিকরা সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান খুলে বসেছেন।
তবে সরকার কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে বড় বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একাধিক প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। প্রকল্পতো হাতে নিলে হবেনা। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনবল ও নীতিমান কর্মকর্তার অভাবে সেই প্রকল্পগুলোর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ বিশ্বের অন্য দেশের এগিয়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে কারিগরি শিক্ষা। আমাদের আশপাশের দেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়নের মূলে কারিগরি শিক্ষা। সেই অবস্থান থেকে এখনো অনেক দূরে বাংলাদেশ।
জাতীয় শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছয় হাজার ৮৬৫। এতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি শর্ট কোর্সের দুই হাজার ৬০০টি ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষার্থীদেরও মূল কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে যোগ করেছে। এসব ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ৮০ হাজার ৩০১। সেই হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৮৫।
শুধু নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কারিগরি বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। এসব শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও অন্তর্ভুক্ত করে কারিগরিতে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী সাধারণ শিক্ষার মতোই কারিগরিতেও একাডেমিক ও সার্টিফিকেট কোর্স রয়েছে। সার্টিফিকেট কোর্স খুবই স্বল্প মেয়াদে হতে পারে। আবার এর ব্যাপ্তি সর্বোচ্চ ৩৬০ ঘণ্টাও হতে পারে। কিন্তু সার্টিফিকেট কোর্স কোনোভাবেই মূল কারিগরি শিক্ষার মধ্যে পড়ে না। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষার অধীনে দুই হাজার ৬১৭টি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্কুল ও কলেজ রয়েছে। সেখানে বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও কম্পিউটার সায়েন্স, হিসাববিজ্ঞান, ব্যাংকিং ও হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এই চারটি বিষয় পড়ার সুযোগ রয়েছে। এসব বিষয় সাধারণ শিক্ষার ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগেও রয়েছে, যা কোনোভাবেই কারিগরি শিক্ষার অধীন নয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের তিন লাখ ৩৫ হাজার ২২৫ জন শিক্ষার্থী বাদ দিলে ২০১৮ সালে কারিগরিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় সাত লাখ ৩২ হাজার ২৫৯। সেই হিসাবে কারিগরিতে শিক্ষার্থীর হার দাঁড়ায় ৮.৪৪ শতাংশ।
আবার সরকারি হিসাবে কারিগরি শিক্ষায় দিন দিন মেয়েদের সংখ্যা কমছে। অথচ সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বর্তমানে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। উচ্চ মাধ্যমিকে ছেলে-মেয়ে সমান সমান হওয়ার পথে। কারিগরিতে ২০১৩ সালে মেয়েদের হার ছিল ২৮.২৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ২৭.৪৩ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২৩.৯৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২৩.৯৫ শতাংশ, ২০১৭ সালে ২৪.২৬ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ২৪.৭৬ শতাংশ।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারিগরিতে যেটুকু উন্নয়ন তা গত ১০ বছরে হয়েছে। বর্তমানে এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার ১৬ শতাংশ। তবে আমরা কারিগরি ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার সমান সমান করতে চাই। ৩১৪টি উপজেলায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১০০টি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। প্রকল্পের অস্থায়ী শিক্ষকদের স্থায়ী করা হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা সব স্কুলে অন্তত একটি করে হলেও কারিগরি ট্রেড খুলতে চাই। কম্পিউটার সায়েন্সকে আপডেট করার চিন্তাও আমাদের আছে। বর্তমানে কারিকুলাম আপডেট এবং শিক্ষকদের দক্ষ করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মানেও উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’
চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লকচেইন টেকনোলজিসহ আধুনিক বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম রয়ে গেছে সেই মান্ধাতার আমলে। কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম নিয়মিত আপডেট হয় না। যাঁরা কারিকুলাম নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাও দক্ষ নন। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানোর সক্ষমতা তাঁদের আছে এমন দাবী করা যায়না। বর্তমানে কারিগরিতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোর কোনো উপযোগিতা নেই। যেমন ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ‘ডিপ্লোমা ইন মাইনিং’। এটি মূলত খনিজ সম্পদ বিষয়ক একটি কোর্স। কিন্তু দেশে খনিজ সম্পদ বিষয়ক সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোও তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এই বিষয়টি চায় না। কারণ অনেক কোর্সেরই একটি বিষয় এটি। ফলে একটি স্বতন্ত্র ডিপ্লোমা কোর্স হিসেবে এর চাহিদা শূন্য। ফলে এ বিষয়ে ডিপ্লোমা করে চাকরি পাওয়া কষ্টকর। তার পরও কোর্সটি চালিয়ে যাচ্ছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড।
বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ের ব্যাপক চাহিদা। দুই বছর আগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এই বিষয়টি চালু করলেও এখনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যায়নি। ফলে যে শিক্ষকের এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাঁকেই পড়াতে হচ্ছে বিষয়টি। বোঝাই যায়, এ বিষয়ে যেসব শিক্ষার্থী পাস করে বের হবেন, তাঁরা কতখানি দক্ষ হবেন।
বিশ্বে প্রতিবছর কারিগরি খাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে। বিশেষ করে লেদার, প্লাস্টিক, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিকস, পোশাক, অটোমোবাইল, এয়ারলাইনস, নার্সিংসহ বেশ কিছু বিষয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের চাকরিদাতারাও কারিগরিতে প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক খুঁজে পাচ্ছে না। এ কারণে অনেক সময় বিদেশ থেকে দক্ষ লোক আনতে হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পোশাক খাতে বর্তমানে অনেক বিদেশি কাজ করছে। অথচ পোশাক খাতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও এখনো প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়নি।
দেশে যেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ স্কুল-মাদরাসার সংখ্যা ৩২ হাজার, সেখানে এসএসসি ভোকেশনাল পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র দুই হাজার ৮৮০। এসএসসি পরীক্ষায় প্রতিবছর অংশ নেয় প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে কারিগরি থেকে অংশ নেয় মাত্র সোয়া লাখ শিক্ষার্থী। গড়ে প্রতিটি উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ স্কুল-মাদরাসার সংখ্যা ৬৫ থেকে ৬৬। সেখানে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচ থেকে ছয়টি।
দেশে সাধারণ সরকারি-বেসরকারি কলেজের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। অন্যদিকে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা মাত্র ৪৯। আর ৪৬১টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থাকলেও ভালো মানের রয়েছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি। ফলে বেশির ভাগ বেসরকারি পলিটেকনিকে আসন শূন্য থাকে।
কারিগরিতে শিক্ষার্থী না বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, সাধারণ শিক্ষা থেকে এসএসসি পাস করেও কারিগরিতে যাওয়া যায়। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা শ্রমবাজারে সাড়া ফেলতে না পারায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হচ্ছে না। অষ্টম শ্রেণি পাসের পর যদি কারিগরিতে শিক্ষার্থী আনা যায়, তাহলে এ খাতে শিক্ষার্থী বাড়বে।
সাধারণ শিক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক কোর্স দুই বছরের। কারিগরিতে ডিপ্লোমা কোর্স চার বছরের হলেও তার মান উচ্চ মাধ্যমিকের সমান। এ ছাড়া কারিগরি থেকে ডিপ্লোমা করে সরকারিভাবে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম। শুধু ডিপ্লোমা করা শিক্ষার্থীরা ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (ডুয়েট) পড়ার সুযোগ পায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগের পক্ষে আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয় না।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোরাদ হোসেন মোল্ল্যা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শর্ট কোর্স এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট (বিএম) কলেজ দুটিই কারিগরি শিক্ষা। কারণ একজন শিক্ষার্থী যদি কম্পিউটার শিখে চাকরি পান তাহলে তা কারিগরি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে না কেন? আর বিএম কলেজে কম্পিউটার ও হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট কোর্স আছে, যা প্রকারান্তরে কারিগরি শিক্ষা।’ তিনি দাবি করেন, বর্তমানে কারিগরিতে শিক্ষার্থীর হার ১৬.০৪ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সরকার কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর যে হিসাব দিচ্ছে, তা সঠিক নয়। কারণ কারিগরি শিক্ষা আর বৃত্তিমূলক শিক্ষা এক নয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষা হচ্ছে বিক্রয় উপযোগী শিক্ষা। আর বৃত্তিমূলক শিক্ষার পরের ধাপ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে এক করে হিসাব করছে। এতে কারিগরির প্রকৃত চিত্র বোঝা অসম্ভবই থেকে যাবে। (পরের সংখ্যায় ঠাকুরগাঁওয়ের চিত্র)