জাকির হোসেন সুমন :“সাপলুডু”বড়দিন এবং ইংরেজী নববর্ষের ছুটির শেষ দিন রবিবার, লিমাট প্লাজের রিফরমিয়ার্টে খ্রিকগেমাইন্ডের স্কুল চৌহদ্দিতে প্রথমে বই উৎসব পরে পিঠা মেলা এবং শেষে বাংলা সিনেমা সাপলুডু প্রদর্শন করে বাংলা স্কুল জুরিখ।
তিন পর্বের আয়োজনে প্রথম পর্বের বই উৎসবে শিশুদের মাঝে টেক্সট বই বিতরণ করেন ১৯৭৮ সালে জুরিখ শহরে প্রথম আসা প্রবাসী বাংলোদেশী, প্রবীন কমিনিটি ব্যাক্তিত্ব, প্রাক্তন ব্যাংকার এবং বর্তমানে রেষ্টুরেন্ট ব্যাবসায়ী মাহাবুর রহমান। তিনি স্মৃতিচারন করে বলেন, একজন থেকে জুরিখে আজ বিশাল বড় কমিউনিটি।তিনি যখন জুরিখে পড়তে এসেছিলেন তখন তিনি জুরিখে কোন বাংলাদেশী পাননি। দেশী খাবার পান নি। কারো সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারেন নি। অথচ আজ আমাদের অনেক বড় এক বাংলাদেশী কমিউনিটি গড়ে উঠেছে এই জুরিখে। যা কিনা সুইজের সবচেয়ে বড় বাংলাদেশী কমিউনিটি। এটা অতন্ত গৌরবের বিষয়। তিনি অন্যান্য ভাষার সাথে বাংলাভাষা শিক্ষার তাগিদ দেন। বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি শিক্ষাটা এখানে আরো বেশী গৌরবের। প্রবীন কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব আবুল হোসেনও শিশুদের বাংলা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে বলেন। বই উৎসবে বাংলাদেশ দুতাবাস গুরুত্ব আরোপ করে অতি দ্রুততার সাথে টেক্সট বই সরবারহ করবার জন্য জেনেভা স্থায়ী মিশনকে স্কুলের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন স্কুলের পরিচালনা কমিটির মধ্যে রোমানা আফরোজ হীরা, আশা আল রহমান, সাহিদা আক্তার ঝুমুর, মনিরুল ইসলাম আক্তার, মোহাম্মাদ নুরুজ্জামান, এবং সুলতানা খান চাঁদনী সহ আরো অনেকে।
এ সময়ে বক্তরা বলেন, এ সব অনুষ্ঠানে দুতাবাসের কর্মকর্তারা অভিবাবক হিসাবে উপস্থিত থাকলে শিশুরা আরো বেশী উৎসাহ পায়। এখানে আর্থিক সহযোগীতা নয় বরং একটা অভিভাবককত্ব সুলভ আত্মিক সহযোগীতাই মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত।বাংলা স্কুল গুলোর জন্য ইউরোপ প্রবাসীরা কোন আর্থিক সহযোগীতা দূতাবাসের কাছ থেকে চায় না।তারা চায় দূতাবাসের নজরদারী এবং ভালবাসা। যদিও ইউরোপে তুর্কির ভাষা শিক্ষা স্কুল গুলোর সবই তুর্কি সরকার নিজেদের অর্থায়নে পরিচালনা করেন। এমন রয়েছে আরো বহু উদাহরন। দেশের সেই সামার্থ হয়তবা একদিন হবে। জুরিখের সাথে জেনেভার দুরত্ব এখানে একটা বড় বাঁধা। এ বাঁধা কেবল জুরিখে একটা কনসোল সার্বিস চালুই অবমুক্ত করতে পারে। সে দাবী জুরিখ প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেক পুরানো দাবী। কিন্তু বারবার কতৃপক্ষের ওয়াদা সত্ত্বেও পুরন হচ্ছে না। মিশন কতৃপক্ষের জন্যওএ বিষয়টি এখন অনেকটা লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।বারবার একই বিষয় নিয়ে কতটাই বা আলোচনা করা সমিচিন বা ভদ্রাচিত বলে চালিয়ে নেয়া যায় সে প্রশ্নও নিশ্চয় আছে। তবে জুরিখে কনসুলেট সেবা চালু না হলেও নতুন প্রজন্মের প্রবাসী সব শিশুদের হাতে একটা বাংলা শিক্ষার বই পৌঁছে দেবার সেই পুরানো দাবীর আংশিক বাস্তবায়ন হচ্ছে। দুতাবাস সে কাজটি করছেন। প্রবাসীরা চাইলে আগামীতে সব শিশুদের জন্যই বই সংগ্রহ করতে পারেন। চাইলেই নিজেদের শিশুদের অন্তত বাংলাটা পড়বার মতো করে গড়ে তুলতে পারেন। সে চাওয়াটা অবশ্যই চাইতে হবে চাইতে গিয়ে যতটা অলসতা আর অবহেলা করা হবে, যত অপ্রয়োজনিয় মনে করা হবে ততই প্রবাসে আমাদের প্রজন্মের সাথে আমাদের সম্পর্ক এবং দুরত্বটা বেড়েই যাবে। শিকড়ের সন্ধানটা আমাদের জন্য সোনার হরিন হয়ে দাঁড়াবে। হারটা হবে আমাদের শেষ সম্বল এবং শান্তনার একমাত্র আশ্রয়। হারতে কেউ চায় না। তাই একটু হলেও বাংলা শিখতে সময় দেবার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানান হয়। ২য় পর্বে ছিল দেশীয় হরেক রকম পিঠা মেলার আয়োজন। এটাও সেই নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে বরাবরের মতো ই একটা আয়োজন। এবারও বাংলা স্কুল আয়োজিত এই আয়োজনটি ছিল নজরকারা। হলভর্তি উপচে পরা অতিথীগনের মধ্যে বেশীর ভাগই নিয়ে এসেছেন নানা স্বাদের পিঠা।কেউ নিয়ে এসেছেন ঝাল করে বানানো হরেক রকমের ভর্তা। আয়োজন ছিল পিঠা প্রতিযোগিতারও। অন্তত অর্ধশত রকমের পিঠার ভিরে পাঠিসাপটা পিঠা বানিয়ে ১ম পুরস্কার ছিনিয়ে নেন জুরিখ প্রবাসী ভাবী মিতু খানজহির, ২য় পুরস্কর পেয়েছেন যৌথভাবে দুই প্রতিযোগী দেবা তালুকদার এবং দীবা নাসরিন। তাঁরা বানিয়েছিলেন চুহি, লবংগো, সোহেলী এবং পুলি পিঠা। দেবা তালুকদার পিঠা এবং ভর্তা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন রাজধানী বার্ন শহর থেকে। মুরালী এবং পাক্কন পিঠা বানিয়ে তৃতীয় পুরস্কার জিতে নেন জুরিখের লুনা তালুকদার। পিঠা নিয়ে উৎসবে অংশ গ্রহনকারী সবাইকে বাংলা স্কুল জুরিখের তরফ থেকে দেয়া হয় উৎসাহী-দীপনা পুরস্কার।উৎসাহ আর উদ্দীপনায় আগামীতেও সবাই পিঠা বানাবেন এটাই চাওয়া। যারা যারা সুস্বাদু পিঠা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন তাদের অনেকের নাম না বললে যেন হয় না পিঠা বানিয়েছেন, জাহানারা ভাবী, তাজুল ভাবী, রুনু ভাবী, ফারজানা ভাবী,ঝুমুর ভাবী, আগেই বলা ছিল, সকল প্রচেষ্ঠা হলো নতুন প্রজন্মকে ঘিরে। তারা বাংলার এই সংস্কৃতি যুগ যুগ প্রবাসে ধরে রাখবে সুপার আঠার মতো করে এ প্রত্যশাই সবার।অসাধ্য সাধনের এই কাজটি অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে সবার। প্রত্যকেই প্রত্যকের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সাধ্যমতো এ কাজটি চালিয়ে যাবার প্রত্যশা সব সচেতন মহলের। অলসতা দূর করে শিশুদের পাশে থেকে তাদের হাতে শুধু ধরিয়ে দিতে হবে আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির এই চলমান নৌকার বৈঠা। শেষে ছিল বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। পাশেই আলাদা হল রুমে বড় পর্দায় বাংলা ছায়াছবি ‘সাপলুডু‘ দেখানো হয়। সে এক বিশাল আনন্দ এবং ভরসার বিষয়, যা কিনা আমাদের ভিষন রকমের আকাংখা যুগিয়ে ভরসার ইতিবাচক জায়গাটি আরো প্রসারিত করেছে। প্রবাসী শিশুরা এত ধৈর্য্য এবং আগ্রহ সহকারে বাংলা ছবি দেখছিল যা ছিল ভিষন আশ্চর্য রকম পাওনার একটা বিষয়, একদম অভাক করার বিষয়।আমরা ধরে নেই আমাদের প্রবাসের শিশুরা বাংলা ছবি দেখতে পছন্দ করে না। আসলে এমন ধারণাটাই ভুল। আর সে ভুল প্রমাণিত করেছে বাংলা স্কুল জুরিখ আয়োজিত এই চলচ্চিত্র প্রদর্শন। এখানকার ছোট ছোট শিশুদের বাংলা ছবি দেখবার আগ্রহ বড়দের অনেকেই অভিভুত করেছে। প্রকৃত অর্থে আমরা আমাদের শিশুদের এমন সুযোগ।