নিউজ ডেস্ক: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আজও ভারতের বিভিন্ন শহরের পাশাপাশি রাজধানী নয়াদিল্লি বিক্ষোভকারীদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে। নয়াদিল্লির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহাসিক জামে মসজিদে শুক্রবার জুমআর নামাজের পর হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় দিল্লির আকাশ-বাতাস ‘মোদি হটাও’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের বিধান রেখে দেশটির নতুন এই নাগরিকত্ব আইন ঘিরে গত কয়েকদিন ধরে টানা বিক্ষোভ করছেন ছাত্র-জনতা। বৃহস্পতিবার দেশটিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি বর্ষণ করেছে পুলিশ। গত কয়েকদিনের সংঘর্ষে অন্তত সাত বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন বলে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে।
শুক্রবার নয়াদিল্লিতে বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেছিল। কিন্তু পুলিশ এতে বাধা দেয়ায় অন্যান্য দিনের মতো মুহূর্তেই এই বিক্ষোভ সাংঘর্ষিক রূপ নেয়। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় শহর ম্যাঙ্গালুরুতে গতকাল বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজনের প্রাণহানির পর শুক্রবার সেখানে তিনদিনের কারফিউ জারি করা হয়েছে।
ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য উত্তরপ্রদেশ কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রচারিত এক সংবাদে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা রাজ্য পুলিশের একটি ভ্যান গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছেন। এ সময় বিক্ষোভকারীদের পাথর নিক্ষেপের জবাবে লাঠিচার্জ করে পুলিশ।
ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী সরকার গত ১১ ডিসেম্বর দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাসের পর এই বিক্ষোভের শুরু হয়। ২০১৪ সালে দেশটিতে ক্ষমতায় আসার পর এমন তীব্র বিক্ষোভ এবং বিরোধিতার মুখে প্রথমবারের মতো পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্সি এবং জৈন সম্প্রদায়ের সদস্যরা সে দেশের নাগরিকত্ব পাবেন। তবে এ আইনে মুসলিম শরণার্থীদের ব্যাপারে একই ধরনের বিধান রাখা হয়নি।
সমালোচকরা বলেছেন, ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ভারতে বিভাজন তৈরি করতে এ নতুন নাগরিকত্ব আইন তৈরি করেছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে।
বিতর্কিত এই আইনে মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে কিছু না বলায় ভারতজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তবে বিক্ষোভের দাবানল বেশি ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে।
সাম্প্রদায়িক সীমায় দাঁড়িয়ে ভারতে বিভক্তি তৈরি করতে এই আইন আনা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দেশটির বিভিন্ন বিরোধী দল, শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ। ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ মুসলিম।
শুক্রবার দিল্লির জামে মসজিদে জুমআর নামাজের পর বিক্ষোভে যোগ দেয় সমাজের উচু জাত থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নবর্গের দলিতরাও। ভারতে হিন্দুত্ববাদী জাতিভেদ অত্যন্ত প্রকট।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, দিল্লির জামে মসজিদের সামনে নামাজের আগে থেকে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর শত শত সদস্য মোতায়েন করা হয়। নামাজ শেষে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় অনেকের হাতে ভারতের পতাকা এবং সংবিধানের কপি দেখা যায়; যেখানে লেখা রয়েছে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র।
মসজিদের বাইরে স্লোগানরত ৪২ বছর বয়সী শামীম কুরাইশি বলেন, এই আইন বাতিল না করা পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। আমরা পিছু হটবো না। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিরোধী স্লোগান দেন।
শুক্রবার দিল্লিতে অমিত শাহর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নারী শাখার সদস্যরা। হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা উত্তরপ্রদেশে শুক্রবার শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভে উত্তাল ছিল এই রাজ্যও।
দেশটির প্রখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবী মোহাম্মদ শোয়াইবকে গ্রেফতার এবং মানবাধিকার কর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এস আর দারাপুরিকে গৃহবন্দি করে রেখেছে পুলিশ। উত্তরপ্রদেশের অন্তত ২০ জেলায় শনিবার পর্যন্ত ইন্টারনেট এবং মোবাইলে বার্তা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।
রাজ্যের কর্মকর্তা আওয়ানীশ কুমার আওয়াষ্ঠি সরকারি এই আদেশ জারির পর এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে এমন উসকানিমূলক বার্তার বিস্তার ঠেকাতে সরকার এই ব্যবস্থা নিয়েছে।
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় শহর ম্যাঙ্গালুরুতে আগামী ২২ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। এই রাজ্যে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দু’জনের প্রাণহানির পর কারফিউ জারি করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তা গুরু কামাত বলেছেন, ম্যাঙ্গালুরুতে সংঘর্ষে অন্তত ২০ পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। পুরো শহরজুড়ে পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে এবং শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে বেশ স্বাভাবিক রয়েছে। সবকিছু পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
সূত্র : রয়টার্স।