• মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫১ অপরাহ্ন

৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের চিন্তা ভাবনা -অ্যাডভোকেট আবু মহী উদ্দীন

সাংবাদিকের নাম / ৫২ জন দেখেছেন
আপডেট : রবিবার, ৩ মে, ২০২০

১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ৩ মে তারিখটিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বছর বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এসেছে এই দিবস। ফলে সংকটময় পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে।
অবশ্য বাংলাদেশে আমরা সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা সংকটের মধ্যেই আছি অনেক বছর ধরে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তৈরি সমীক্ষাগুলোর মতে অন্তত ২০১৩ সালের পর থেকে আমাদের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কমেছে। ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ২০২০ সালের সমীক্ষা সূচকে দেখা যায়, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১। আগের বছরের তুলনায় আমরা এক ধাপ পিছিয়েছি। দুঃখজনক বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সবচেয়ে পিছিয়ে আছি। এমনকি পাকিস্তান আফগানিস্তানের মতো অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সন্ত্রাসবাদ, জাতিগোষ্ঠীগত বৈরিতা ও যুদ্ধবিগ্রহের দেশের চেয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।
স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে যত রকমের বাধাবিপত্তি চিন্তা করা যায় , তার প্রায় সব উদাহরণই বাংলাদেশে রয়েছে। জাতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকের বিরুদ্ধে ৭০-৮০টি মামলা দায়ের করার (এবং হয়রানিমূলক জেনেও সেসব মামলা বিচার্য বলে গ্রহণ করা হয়েছে ) দৃষ্টান্ত থেকেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিবেশ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা যায়। সরকার যে ভাবেই বলুক বা যাই বলুক , দেশে এবং দেশের বাইরে সংশ্লিষ্ট সবাই বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এই বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত। আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোর অভিজ্ঞতা এই রকমই। কয়েক বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ থেকে শুরু করে নানা ধরনের বাধা ও হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকা। স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগগ্রস্থ করতে নানা কৌশল নেওয়া হয়।
দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও অন্যান্য জাতীয় দুর্যোগের সময় অবাধ তথ্যপ্রবাহের গুরুত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের দেশে ভিন্ন প্রবণতা লক্ষনীয়। সরকারের নেতারা সম্ভবত ভুলে গেছেন যে বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন নামে একটি আইন বলবৎ আছে, যার অনেকগুলো ধারা এই মুহূর্তে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ পর্যায়ক্রমিকভাবে লঙ্ঘন করছে। করোনা-সংক্রান্ত সব তথ্য সঠিকভাবে জনসমক্ষে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রকাশ করার বিধান অনুসরণ এবং সংবাদ ও মতপ্রকাশের মুক্ত পরিবেশের পথ সুগম করা এই মুহূর্তে একান্ত জরুরী । এই সংকট মোকাবিলায় সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মহলের তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার জরুরী বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার বিকল্প নেই।
চলমান করোনা সংকটের কালে সংবাদমাধ্যম যখন ওয়াচডগের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছে; যখন সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে এই সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালনে তৎপর, তখনো তাদের সামনে নানা রকমের বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের দায়ে পত্রিকা সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাংবাদিককের পেটানোর খবর ছাপানো হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ৫ এপ্রিলে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ৫১ জন সাংবাদিক বিভিন্ন পর্যায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন। আমাদের সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকট বহুলাংশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অকার্যকারিতা ও দুর্বল গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে সম্পর্কিত। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহল অনেক সময়েই স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্র পরিচালনার সহায়ক শক্তি হিসেবে গ্রহণ করার পরিবর্তে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে। এই বিবেচনা থেকেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য প্রতিকূল ও সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক কালাকানুন প্রণয়ন করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ব্যাপক সমালোচনার মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে অধিকতর কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার অপপ্রয়োগের অন্য কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
দেশে দেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থা পর্যালোচনা করে , যখন সংবাদপত্রের মাধ্যমের মুক্তি বা স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারনের জন্য সাংবাদিকদের জীবনে বছরে একটি দিন আসে, যে দিন ফিরে দেখা হয় দেশে দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কী অবস্থা।
আলাদা কিন্তু আমাদের দেশে সরকার এবং সরকারি দল আলাদা করা সহজ নয়। সরকারী কর্মকর্তারা অদক্ষতা প্রদর্শন করবে , দায় বহণ করতে হয় সরকারপ্রধান সহ সরকারি দলকে। আমলাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সুবিধাবাদীরা সুযোগের সন্ধান করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়। দায় পড়ে শাসক দলের উপরে। গলা ব্যথা হবে বলে গলা কেটে ফেলা তো কোন সমাধান নয়। কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সরকারি প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। কারণ, দুই কর্তৃপক্ষের দুই রকম ভাষ্য নিয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রশ্ন হলো দুই কর্তৃপক্ষের ২ রকমের ভাষ্য হবে কেন? তার মানে সমন্বয়ের অভাব আছে। এটা সংবাদ সন্মেলনে প্রকাশ হলে বরং লাভ হবে তা হলো আমলারা সংবাদ সন্মেলনে আসার আগে কমপক্ষে আলাপ করে তথ্য সমৃদ্ধ হয়ে আসবেন , যাতে কথা এক রকমের হয়। এতে করে সদস্যদের মধ্যে সমন্বয় বাড়বে। আবার মুগদা এবং খুলনার চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থার সুত্র হলো নিন্মমানের মাস্ক সরবরাহ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাই যদি হয় সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সেখানে তাদের রক্ষা করার জন্য অপচেষ্টা চলছে বলে জনমনে আশংকার ডালপালা গজাচ্ছে। ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে। এই ঘটনায় যদি কোন কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে আখেরে দায় বহন করতে হবে শাসক দলকে। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সুবাদে পার পেয়ে যাবেন দুষ্ট চক্র। দেশের যে সব সাংবাদিকরা ভুয়া খবর পরিবেশন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অবশ্যই জরুরী। আমাদের সংবাদপত্রের গ্রামীন জনপদে যারা সাংবাদিকতার সাথে জড়িত তাদের কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সাংবাদিকতা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রশিক্ষন নেই। এরা বেতনভুক্ত নয়। এরা অধিকাংশই স্থানীয়ভাবে আয় করে খায়। গনমাধ্যমকে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। সংবাদপত্রের মালিক হতে অভিজ্ঞতা বা তেমন কোন জামানত লাগেনা কিংবা তেমন কোন কার্যকর পূর্বশর্ত নাই। আজকের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে বিষয়টি নিয়ে ভাববার মতো।


এধরনের আরও সংবাদ