নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করে বিশ্বের উন্নত ও প্রযুক্তিনির্ভর দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং সিঙ্গাপুরের আদলে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, বিশেষজ্ঞসহ সব স্টেকহোল্ডারকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ সমন্বিত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে কনশাস কনজ্যুমার সোসাইটি (সিসিএস)।
সিসিএস আয়োজিত ‘ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য : চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বক্তারা। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে শনিবার এটি অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ’র (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) আদলে একক সংস্থার ধারণার প্রয়োজন আছে। এখানে একক সংস্থার ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। এটা নিয়ে আলোচনা এবং এগোনো খুব প্রয়োজন। আবার ‘ওইটা না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা যাবে না’- এ মানসিকতার মধ্যে ঢোকা যাবে না। বাংলাদেশে এটাও একটা সমস্যা, একটি কর্তৃপক্ষকে স্বাধীন হতে হবে। কেন সে একটা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে? ‘কর্তৃপক্ষ’ শব্দ ব্যবহার করছি কিন্তু সেটায় স্বাধীনতা দিচ্ছি না।
একক সংস্থাকে তার দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা দিতে হবে। এফডিএ তাদের পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পায়, আমাদের সেই সুযোগ দিতে হবে- বলেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ।
বৈঠকে সুপারশপের প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সরকারের কয়েকটি সংস্থার কাজে সমন্বয়ের অভাব আছে। তাই দায়িত্ব একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে দেয়া উচিত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএর (ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) আদলে একটি সংস্থা গঠনেরও প্রস্তাব দেন।
আলোচনায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে এখানে ৪-৫টি সংস্থা কাজ করে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, সিটি কর্পোরেশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর তো আছেই। এর বাইরে র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কাজ করে। এখানে আমার মনে হয়, একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে যদি দায়িত্ব দেয়া হয় এবং অন্যান্য সবাই কাজ করে সেক্ষেত্রে কাজের সমন্বয় ভালো হতে পারে। কারণ, আমরা এখন সমন্বয়হীনতার মধ্যে কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার সদিচ্ছা আছে। এ সদিচ্ছা বাস্তবে রূপ দিতে সিঙ্গেল ডাইমেনশনে কাজ না করলে সঠিক ফল পাওয়া যাবে না।’
এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডের পরিচালক কামরুল হাসান বলেন, জনগণকে সচেতন করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। কারণ, সাধারণ মানুষ অ্যানালাইসিস না করে সরল বিশ্বাসে পণ্য কেনেন। যখনই বিশ্বাসে ঘাটতি তৈরি হয় তখন আর কিনতে চান না। এখানে প্রথম কাজটি সরকারের রেগুলেটরি বডির। তারা নিশ্চিত করবে যাতে খাদ্যে কোনো ভেজাল না আসে। এটা একমাত্র সম্ভব সুশাসনের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, ভেজাল আর নিম্নমান- দুটি দুই জিনিস। চিনির সঙ্গে লবণ মেশালে সেটা ভেজাল আর লবণের আর্দ্রতার মাত্রা একটু বেশি বা কম থাকলে সেটা কিন্তু ভেজাল নয়। এটাকে আবার নিম্নমানও বলা যায় না। এগুলোকে সামাজিক মাধ্যমে আবার ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে আমরা নেগেটিভ ব্র্যান্ডিং করছি। একটা ব্র্যান্ড তৈরি করতে ২০-২৫ বছর সময় লাগে, এটাও কিন্তু এত সহজ কাজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত বড় দেশেও কিন্তু এফডিএর মতো একটিমাত্র সংস্থা কাজ করে। কিন্তু আমাদের এখানে অনেক সংস্থা।
চেইন সুপারশপ মীনা বাজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহীন খান বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে যা যা করা হচ্ছে এর ফাঁকে অনেক জিনিস বাদ পড়ে গেছে, যা কেউ দেখছেন না। বিএসটিআই নির্দিষ্টসংখ্যক পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যদি সে কয়টি পণ্যের দিকে তাকাই, তাহলে কী তাদের মান সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে? সেটা হয়ে থাকলে, সেই পণ্যে যখন ভেজাল পাওয়া যায়, এজন্য কেন হাইকোর্টের নির্দেশ লাগবে পণ্যের উৎপাদন বন্ধ করতে? তার মানে, ওই প্রতিষ্ঠানেও ভেজাল আছে। যার কারণে ভেজাল পণ্য মার্কেট থেকে তুলে নেয়ার ক্ষমতা রাখছে না।
‘আমার মনে হয় সর্বোপরি একটা প্রতিষ্ঠান দরকার, যদি সরকার সিরিয়াসলি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে চায়। যেভাবে কাজটি হচ্ছে, এভাবে কাজটি করা যাবে না। একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে ঠিকই কিন্তু আমাদের কাছে পরিষ্কার নয় তারা কীভাবে কাজ করেন?’
স্বপ্ন সুপার শপ-এর হেড অব সেলস শামসুদ্দোহা শিমুল বলেন, ‘আমাদের সমস্যাটা হলো সুশাসনের জায়গায়। আমি বাইরের অনেক দেশেই দেখেছি যে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ একদম উৎপাদন পর্যায় থেকেই থাকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এখানে অনেকগুলো রেগুলেটরি বডি কাজ করছে, যে কারণে কাজের মধ্যে ভারসাম্য হারাচ্ছে।’
আলোচনায় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা যদি সবাই মিলে কাজ করি, উৎপাদন থেকে শুরু করে; সমস্যাগুলোর প্রতি যদি একটু মনোযোগ দেই, তাহলে সমাধান সম্ভব। একই সঙ্গে আমাদের দায়িত্বশীল যেসব সংস্থা আছে তাদের ৫২টি নিম্নমানের পণ্যের বিষয়ে আরেকটু গভীরে যাওয়া উচিত ছিল। কারণ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ল্যাব আছে। তাদের মান নিয়ন্ত্রক বিভাগ উপেক্ষা করে এসব পণ্য বাজারে কীভাবে এলো? এখানে দায়ী কে ছিল- বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখতে হবে।’
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, সরকার ধরাধরির জায়গায় নয় বরং সরকার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পক্ষে। এ সরকার ব্যবসাবান্ধব সরকার। আমাদের সুপার শপগুলো এখন অনেক স্ট্যান্ডার্ড। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এ কাজটি সমন্বিতভাবে করতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহকারী সম্পাদক সফিউল্লাহ আল মামুন, সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামীমা শাহরিয়ার প্রমুখ। অনুষ্ঠানের শুরুতে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন এম জাকির হোসেন খান।