বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের সংহতির দিন,মহান মে দিবস। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই শ্রমিকরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করত। দৈনিক ১৪-১৮ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করার পরও তারা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হতো। শোষন বঞ্চনা ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। সকল সভ্যতার ভিত্তিমুল শ্রমিকদের ঘামে ভেজা শ্রম হলেও তারা বরাবরই ছিল উপেক্ষিত। তাদের নির্দিষ্ট কোন ছুটির দিনও ছিল না। এ শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে, এর প্রতিবাদে শ্রমিকরা ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে যে আন্দোলনের সূচনা করে তা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় ৩ ও ৪ মে। শাসকগোষ্ঠী আতঙ্কিত ও দিশেহারা হয়ে শ্রমিকের ওপর লেলিয়ে দেয় পুলিশ। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মর্কেটের ওই শ্রমিক আন্দোলনে পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে কমপক্ষে ১১ জন শ্রমিক নিহত এবং বহু আহত হয়। অনেক শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতারসহ দিনের পর দিন আটকে রাখা হয় কারাগারে। তাদের মধ্যে ৭ জনকে দন্ডিত করা হয় মৃত্যুদন্ডে। শ্রমিক আন্দোলনের ওই অধ্যায়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্যারিস কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে মে দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে উদযাপিত হয় দিনটি।
শ্রমিক বঞ্চনার ইতিহাস নতুন নয়। সব যুগে, সব সমাজে এটি ছিল ও আছে। প্রায়ই তারা প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামতে বাধ্য হন। শ্রমিকরাজ কায়েম হয়েছিল সোভিয়েত ইউনয়নে। ৭০ বছর তারা ভালই ছিল কেন যে সব আবার আগের অবস্থায় ফিরে এল তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। সম্প্রতি শ্রমিক কল্যাণে আমাদের দেশে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তাদের সার্বিক চাহিদা ও কল্যাণ পুরোপুরি সুনিশ্চিত হয়েছে তা বলা যাবে না। শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা,বর্তমান সরকার পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ধার্য করেছে যদিও এটা ছিল সকল শ্রমিকের দাবী।
তবে এখনও কোন কোন ক্ষেত্রে দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে অনেক শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পায় না। তার ওপর বেতন বকেয়া, শ্রমিক ছাঁটাই, লকআউট ইত্যাদি কারণেও তাদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত থাকে না। সকল কারখানার কাজের পরিবেশও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় যে কোন দুর্ঘটনায় শ্রমিককেই প্রাণ দিতে হয়। চা, চামড়া, পাটসহ অন্যান্য শিল্পের চিত্রও প্রায় একই। একটা কথা সকলকে মনে রাখতে হবে, শ্রমিক স্বার্থসংরক্ষণ ব্যতীত যেমন শিল্পের বিকাশ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা শিল্পের ক্ষতিসাধনও শ্রমিকের ভাগ্য বিড়ম্বনা বাড়ানো ছাড়া কোন কাজে আসেনা।
বর্তমান সময়ে করোনা দুর্যোগে সারা দুনিয়া। পৃথিবীর তাবৎ দেশ আজ দিশেহারা। সামান্য ভইরাস যাকে দেখা যায়না , কোন সভ্যতা , কোন অস্ত্র , কোন চিকিৎসা তাকে ঠেকাতে পারছেনা। নাসাতে ভর্তি অস্ত্র , যা দিয়ে সারা পৃথিবী কয়েকশবার ধংশ করা যাবে, তা পড়ে আছে। বিভিন্ন দেশে পারমানবিক বোমা পড়ে আছে। অথচ পৃথিবীর দেশে দেশে কোটি কোটি শিশু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অস্ত্রেও এই উন্মাদনা , বা ঝনঝনানি আজ আর কোন কাজে আসছেনা। পক্ষান্তরে সমাজ ব্যবস্থার কারনে আজ কিউবা, ভিয়েতনাম, কোরিযা, নেপাল , ভুটান , করোনাকে প্রায় নিয়ন্ত্রন করেছে। আবার যে চীন থেকে করোনার উৎপত্তি তারাও প্রায় নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবা আজ বিদেশে চিকিৎসক সরবরাহ করছে। কিউবা এবং ভিয়েতনাম নিজেদের দেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য বিনির্মানে ভুমিকা রেখেছে। সে তুলনায় আমরা দারিদ্র বিমোচন করতেই হিমসিম খাচ্ছি। আমাদের দেশে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য খাতে যা বরাদ্দ হয়েছে আজ বুঝতে পারছি তা ইঁদুরের গর্তে চলে েেগছে। সরকারি দল ও সরকারের পৃষ্ট পোষকতায় তা ঘটেছে। বিষয়টির খোজ খবর করা জরুরী।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতাকে ভাবতে হবে নতুন করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি, বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রায় সব শিল্পকারখানা প্রবেশ করেছে অটোমেশনের যুগে। শ্রমিকদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে রোবট, কম্পিউটার, মাল্টিটাস্কিং ইত্যাদি। বিজিএমইএ-এর সভাপতির মতে, দেশের ত্রিশ লক্ষাধিক পোশাক শিল্প শ্রমিক প্রায় নিরক্ষর। তারা প্রাথমিক লেখাপড়া ও গণিত জানে না। কোডিং তো বহুদূর। অটোমেশন হলে এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক যাবে কোথায়? এর জরুরী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে শিল্প-কারখানার মালিক, বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকদের। শ্রমিকদেরও সংগঠিতভাবে সে প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে। মে দিবসে এবিষয়ে সার্বিক আলোচনায় একটা দিক নির্দেশনা পাওয়া যাবে আশা করি।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। একটি দেশের উন্নয়নের অন্তরালে থাকে শ্রমিক-মজুরদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ব্যথা-বেদনা। কিন্তু সে অনুযায়ী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না। যাদের ঘামে একটি একটি ইট সাজিয়ে বড়ো বড়ো ইমারত সদৃশ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া আবশ্যক। শ্রমিকদের যথাযথ মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হতে হবে সব শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হোক সুপ্রতিষ্ঠিত এবং গড়ে উঠুক শান্তির পৃথিবী।