জাতির বাতিঘর অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে জিতেছিলেন , করোনার কাছে হেরে গেলেন। মৃত্যুর বয়স তাঁর হয়েছিল কিন্তু অপঘাতে তাঁর মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো নয়। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য লাখো জনতা ছুটে আসতো। প্রিয় মানুটিকে শেষ বারের মতো এক নজর দেখার জন্য কি চেষ্টাটাই না করতো। শবদেহ ফুলে ফুলে ভরে উঠতো। অন্তিম যাত্রায় অসংখ্য গুনগ্রাহী সামিল হতো। রাষ্ট্রীয় সম্মান তাঁকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু স্বাস্থ্য বিধি মেনে তাঁর দাফন হয়েছে আত্মীয় স্বজন ছাড়াই। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। করোনা দুর্যোগ চলাকালীন তিনিতো স্বাস্থ্য বিধি মেনেই চলেছেন। তিনিতো শপিংয়ে যাননি, বাসাতেই তো ছিলেন। তিনিতো পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেছেন। তারপরেও তিনি কেন করোনায় আক্রান্ত হলেন ভাববার বিষয়। তিনজন ডাক্তার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। আমরা না হয় বুঝিনা কিন্তু ডাক্তার সাহেবরাতো যথেষ্ট সচেতন। তার পরেও করোনার কাছে তাদের আত্ম সমর্পন করতে হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা মানুষকে করোনা থেকে বাঁচাবার জন্য কাজ করতে গিয়ে নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে জীবন দিচ্ছেন। সরকারি দায়িত্ব পালনে বা মানুষের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের দায়িত্ব¦ পালনে অস্বীকার করার সুযোগ নাই। স্বাস্থ্যকর্মী আর আইন শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা জীবন দিচ্ছে। তারা মানুষকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন পরিবার পরিজন , আত্মীয় ,স্বজন সবার কাছ থেকে আলাদা হয়েছে। নিজের সন্তানকে কাছে নিতে পারছেনা। যে সব বাড়ীতে তারা ভাড়া থাকেন বাড়ীর মালিক তাদের রাখতে চায়না। ভাাবুনতো সেই বাড়ীর মালিক যদি করোনা আক্রান্ত হয় তিনি বাড়ী ছেড়ে কোথায় যাবেন? তাকে তো স্বাস্থ্য কর্মীর কাছেই যেতে হবে। সেই স্বাস্থ্য কর্মীই তাকে দেখবেন এবং তাকে নিরাময় করে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
করোনা ভাইরাসের কোভিড ১৯ এর ঝড়ে সারা দুনিয়া কাত। ১৮৮ টি দেশে সংক্রমন হয়েছে। ৫০ লাখের বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রায় সোয়া তিন লাখ মানুষ মারা গেছে। আমাদের দেশেও মারা গেছে ৪০৮ (২২ মে ২০২০) এই মৃত্যুর মিছিল কোথায় থামবে তা আমরা জানিনা। । যে কটা দেশ বাঁকী আছে তারাও স্বাদ গ্রহণ করবেনা সে কথা বলা যায়না। এটাকে নিয়ন্ত্রন করতে সারা দুনিয়ায় অসংখ্য বিজ্ঞানী কাজ করছেন। কখনো কখনো আশার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমরা বাঁচার জন্য আশাবাদী হচ্ছি। সমস্যা হলো একসময় এর টিকা আবিস্কার হবে , কিন্তু সে টিকা আমাদের পর্যায়ে আসতে বা দুনিয়ার ৭৮০ কোটি মানুষের কাছে এই টিকা পৌঁছানোই সম্ভব হবেনা। তার মানে এ সমস্যা থাকবেই, তবে নিয়ন্ত্রন সম্ভব হবে। এই ভাইরাস নাকি ইচ্ছামতো চরিত্র বদল করতে পারে, না হলে কবে ঔষধ আবিস্কার হতো , সমস্যাতো সেখানেই।
আমেরিকার মতো বিশ্ব মোড়লের দেশ , সে দেশের প্রেসিডেন্ট গরীব বা মাঝারী অর্থনীতির দেশের সরকার প্রধানের সাথে টেলিফোনে কথা বললে সে দেশের সরকার প্রধান নিজেকে ধন্য মনে করে। সে দেশের প্রেসিডেন্ট একটু পাগলাটে বলে দুর্নাম আছে। এই পাগলামির জন্য মাসুলও দিতে হচ্ছে আমেরিকাকে। আমেরিকা বিত্ত বৈভব , সম্পদ , শিক্ষা , চিকিৎসা সভ্যতায় সেরা দেশের মধ্যে ,আবার শক্তিতে অস্ত্রপাতি জমা করাতে ১ নম্বর। তাদের অস্ত্র দিয়ে সারা দুনিয়া মুহুর্তেই কয়েকবার ধংশ করতে পারে। তবে করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের মতো গরীব কম শিক্ষিত দেশের চেয়ে খুব ভালো আচরন করেছে সে কথা বলা যায়না। নিউইয়র্কের মতো রাজ্যে মৃত্যুর ধস ঠেকানো যায়নি। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা বা স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের চেয়ে খুব ভালো আচরন করেনি।
পৃথিবীতে এখন যাঁরা মোড়লের ভূমিকা পালন করছেন, বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে তাঁরা যেমন অসামান্য নন, উঁচু মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষও নন নিম্ন মাঝারি বা তার চেয়েও নিচের স্তরের মানুষ। তাঁদের নেই কোনো মানবতাবাদী জীবনদর্শন ও নৈতিক মূল্যবোধ। মানবজাতির ভবিষ্যতের প্রতি তাঁদের কোনো অঙ্গীকার নেই। সুতরাং করোনার প্রকোপ প্রশমিত হলেও পৃথিবীর পুনর্গঠনে তাদের ভূমিকা থাকবে, তা আশা করা যায় না।
এখন আমাদের দেশে সরকার কতো চেষ্টা করছে। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের যেমন কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা সে কারণে কি করতে হবে বুঝে উঠতে সময় নিয়েছে , তার পরেও অনেক উন্নত , সভ্য দেশের চেয়ে আমরা এখনো ভালো আছি তবে কতদিন থাকতে পারব সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেননা আমাদেরকে জীবন এবং জীবিকা দুটোর সমন্বয় করতে হচ্ছে।
সরকারি , বেসরকারি প্রচার প্রচারণা , টিভি চ্যানেল ফেসবুক প্রচারপত্র, খবরের কাগজ , বিভিন্ন সংস্থার তরফ থেকে স্বাস্থ্য বিধি প্রচার, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার তাগাদা দিয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যবিধি জারী করেছে। ব্যক্তিগত দুরত্ব বজায় রাখার জন্য বাব বার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। সরকার লকডাউন করেছে আবার জীবন জীবিকার কথা বিবেচন করে কেবল মাত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে শপিং সেন্টার গুলো খুলে দিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই আমাদের চেতনা কাজ করছেনা। আমরা ব্যক্তিগত দুরত্ব বজায় রাখছিনা। হাত ধোওয়াও যে খুব একটা হয়ে উঠছে তাও না। অনেক দোকান মালিক চমৎকার ব্যবস্থা রেখেছে। তবে মোটামুটিভাবে প্রায় লোকই মাস্ক পড়েছে। মাস্কগুলো কি উপকার করছে তা বলা না গেলেও একেবারে যে উপকার হবেনা তা নয়। অন্তত কথা বলার সময় । অনেকের থুথু ছিটিয়ে যায় সেটা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আর এটাই তো প্রয়োজন। আর একটা উপকার হবে তা হলো আমরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মুখে বা নাকে হাত দিই। এই নাকে মুখে হাত দেওয়া একটা জটিল বিষয়। এতে করেই করোনা ভইরাস মুখে এবং নাকের মাধ্যমে কন্ঠ নালীতে পৌছায়। এই মাস্কটা মুখে থাকলে হাত সহজে নাকে মুখে লাগবেনা এটাই মূল লাভ। আবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তা বলা হয়েছে , মাঝে মাঝে লবন ও গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আদা , লবংগ ইত্যাদি দিয়ে চা খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিষয়গুলি যদি বিবেচনায় আনা যায় তাহলে করোনা ভাইরাস যতোই শক্তিশালী হহেক , যতই চিচিৎসা না থাক একে ঠেকানো খুব কঠিন নয়। সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় হলো করোনা নিজে থেকে কারো কাছে আসেনা, করোনাকে আমন্ত্রন জানিয়ে আনতে হয়। আমন্ত্রন না জানালেই হয়। আমন্ত্রন না জানানোর কায়দা খুব কঠিন নয়। শপিং সেন্টার গুলি খুলে দেওয়ার পর আমরা একটু সংযমী হয়ে যদি মাস্ক ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত দুরত্বটা বজায় রেখে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু সময় নিয়ে বাজার বা কেনা কাটা করতাম তাহলে কোন কর্তৃপক্ষকেই আবারো দোকান বন্ধ করার মতো বাজে সিদ্ধান্ত নিতে হতোনা। ক্রেতারা একটু সংযমী হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনা কাটা করলে ব্যবসায়ী , ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা , যেমন লাভবান হতো তেমনি ক্রেতারাও তাদের শখের কেনাকাটা করতে পারতো। আবার যারা উৎপাদক তারাও লাভবান হতো। সব দিক থেকে লাভবান হবার অপার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও আমরা ক্ষতির শিকার হলাম নিজেদের দোষে। জীবন জীবিকা দুটোই রক্ষা হতো। এখন তো আম ছালা দুটোই গেল।
করোনাকে পুঁজি করে আমাদের অসৎ ব্যবস্যয়ীরা কম যাচ্ছেননা। যেটাতেই সুযোগ পাচ্ছেন সেটাই কাজে লাগাচ্ছেন। চাল ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিলেন , পেয়াজের দাম বাড়িয়ে দিলেন। রমজানের শুরুতে ব্রয়লার মুরগী ১০০ টাকা কেজি ছিল এখন ১৮০ টাকা কেজি। বাদাম , বুট , মসুর , এসবের দামতে প্রতিবারই বাড়ে, এবারেও বেড়েছে। এটাতো মানুষ নিয়তি বলেই মেনে নেয়। লেবু এবারে অভিজাত শবজি। রসবিহীন লেবু ৪০/৫০ টাকা হালি। বাঙ্গালীর অজুহাত নামক ৩য় হাতটি খুবই শক্তিশালী। বাজারের যে সব জিনিষ বাইরে থেকে আসে তার দাম বেশি হবে, অজুহাত, মাল আসছে না। আড়তদাররা বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়ায়। ভোক্তা অধিকারের বাজার অনুসন্ধানে জানা গেল আড়তে ৯৮ টাকার আদা ৩৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ২/১ জনের দন্ড জরিমানা হয়েছে। তাতে যে খুব বেশি কিছু করা গেছে এমনটা নয়। অথচ মালামাল পরিবহনে কোন সমস্যা হতে দেয়নি সরকার। আর স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি পণ্য , একেবারে উৎপাদনকারী কৃষক মাঠে মারা গেছে। ঠাকুরগাঁওয়ে করলা ৫ টাকা কেজি , ঢেঁড়স ৫ টাকা কেজি , শসা ৫ টাকা কেজি , ডাটা , লালশাক, পানি কুমড়া একেবারে পানির দাম। লেবার খরচ উঠছেনা। শবজি আবাদ করে কৃষকের চামড়া পিঠে লেগে গেল। রমজান মাসে বেশি শবজি মানুষ খায়না। এই সব কৃষকদের বাঁচানোর ব্যবস্থা করা খুব জরুরী। মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সময় এই সব শবজিও খাদ্য সহায়তা হিসাবে দেওয়া দরকার। ঠাকুরগাঁওয়ে জেলা প্রশাসন বিষয়টা অনুধাবন করেছে । তারা চাল ডালের সাথে এই সব সবজিও খাদ্য সহায়তা হিসাবে দিয়েছে। এতে অন্ততঃ কিছু মানুষের শবজিগুলো কাজে লেগেছে। এই উদ্যোগটি খুবই প্রশংসিত হয়েছে।
করোনা যে শুধু মানুষের জীবনের ওপর আঘাত হানছে তাই নয়, অনেক প্রচলিত ব্যবস্থাকে অকার্যকর প্রমাণ করেছে। করোনা নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের রোজগার যেমন বন্ধ করেছে, তেমনি আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে। এই যে তিন মাস যাবৎ তাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন না, তাতে দেশ চমৎকার চলছে। করোনা প্রমাণ করল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝেমধ্যে দল বেঁধে বিদেশ ভ্রমণ না করলেও দেশ চলে। পুকুর খনন করা শেখাসহ , বিল্ডিংয়ে লিফট লাগানো হবে সেটার আকৃতি প্রকৃতি দেখা সহ বিভিন্ন ছুতো নাতায় সদলবলে বিদেশ সফরে গত ২০ বছরে রাষ্ট্রের যে টাকা নষ্ট হয়েছে, সেই টাকা থাকলে এক বছর চার-পাঁচ কোটি মানুষকে বসিয়ে খাওয়ানো যেত।
পৃথিবী থেকে এই ভাইরাস কবে বিদায় নেবে না নেবে, আদৌ নেবে কি না, তা তার মর্জির ওপর নির্ভর করে। তাতে কোনো সুপারপাওয়ার বা ডেপুটি সুপার পাওয়ারের হাত নেই। এ ব্যাপারে তাদের বিজ্ঞানীরাও নাচার। মানুষ শুধু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারে। যদি অল্প সময়ের মধ্যে চলে যায় তো গেল, যদি করোনা মনে করে যে দুনিয়ায় আরও কিছুদিন থাকবে, তাহলে পরিস্থিতি জটিলতর আকার ধারণ করবে।
করোনা এমন এক জীবাণু, যা বিদায় নিলে সব দেশ থেকেই নিতে হবে। যদি কোনো কোনো দেশে থেকে যায়, তা অন্যান্য দেশের জন্যও ঝুঁকি, যদি আমরা মনে করি কোনো রকমে বাংলাদেশ থেকে তো করোনা পালিয়েছে, অন্যেরা মরে মরুক, তা খুব ভুল চিন্তা। যেসব দেশের ব্যাংকে আমাদের ভাগ্যবানেরা টাকা পাচার করেছেন, যদি সেসব দেশে করোনা থেকে যায়, আমাদের ব্যবসায়ী ও কালোটাকার মালিকদের জন্য তা কোনো সুসংবাদ নয়। সুইজারল্যান্ডে আজ পর্যন্ত মারা গেছেন ১ হাজার ৮৮০ জনের বেশি। টাকা পাচার করে সুইজারল্যান্ডে , কানাডায়, অষ্ট্রেলিয়ায় দিয়ে বসবাস করবেন সে সুযোগ থাকছেনা কেননা করোনা ওখানেও হানা দিয়েছে।