নিউজ ডেস্কঃ নিজেদের ভুল স্বীকার না করে মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙে সাংবাদিক রিগ্যানকে ধরে এনে গুলি করে হত্যার হুমকি ও বিবস্ত্র করে পেটানো ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে সাফাই গাইলেন কুড়িগ্রামের প্রত্যাহার হওয়া ডিসি সুলতানা পারভীন। অভিযানটি বিধি-বিধান মেনেই পরিচালিত হয়েছে দাবি করে তিনি এক খোলা চিঠিতে বলেছেন, ‘অভিযান পরিচালাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষাকৃত অনেক নবীন ও যেহেতু আদালত কিছু বিধি-বিধান এবং পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়, সেহেতু উক্ত বিধি-বিধান এবং পদ্ধতি প্রয়োগে অনিচ্ছাকৃত ভুল হতেই পারে।’
যেখানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বলছেন, এই অভিযানটি সঠিক ছিল না। সেখানে অভিযানটি ‘সঠিক’ ছিল দাবি করেছেন ডিসি সুলতানা পারভীন।
সাংবাদিক রিগ্যানের ওপর হামলা, মাদক মামলা সাজিয়ে তাকে ফাঁসানোকে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল হতেই পারে’ ডিসির এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ অনেকেই।
মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাংবাদিককে কারাদণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনায় কুড়িগ্রামের প্রত্যাহার হওয়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। সর্বস্তরের মানুষ তার সমালোচনা করেন। শুধু সর্বস্তরের মানুষই নয়, স্বয়ং হাইকোর্ট এ ঘটনায় বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন। সেসব ঘটনাকে সামাল দিতে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন তার ফেসবুকে কুড়িগ্রামবাসীর উদ্দেশে আবেগঘন এক খোলা চিঠি লিখেছেন। সময় নিউজের পাঠকদের জন্য ডিসি সুলতানা পারভীনের লেখা পুরো চিঠিটি তুলে ধরা হলো।
‘প্রিয় কুড়িগ্রামবাসী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সহকর্মী ও সুধীজন,
মোবাইল কোর্ট পরিচালনা নিয়ে সৃষ্ট সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় পরিবেশিত ও প্রকাশিত সংবাদ বিষয়ে আমার অবস্থান এবং কুড়িগ্রাম জেলায় দুবছর কর্মকালে আমার কতিপয় গৃহীত উদ্যোগ অবহিত করছি।
গত ১৩ মার্চ ২০২০ দিবাগত রাতে নিয়মিত কার্যক্রমের আওতায় কুড়িগ্রামে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চাহিদার প্রেক্ষিতে ৬ জন পুলিশ, ৫ জন আনসার এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টরসহ ৩ জন এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স অভিযানের অংশ হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। আমি পরদিন সকালে ১৪ মার্চ ২০২০ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও আদেশের বিষয়টি অবহিত হই। সংশ্লিষ্ট এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। তিনি যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে মর্মে আমাকে অবহতি করেন। অভিযান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা অনাকাঙ্খিত এবং এ বিষয়ে আমাকে দায়ী করে যে সংবাদ প্রকাশিত ও পরিবেশিত হচ্ছে তাতে আমি প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত। উল্লেখ্য, অভিযান পরিচালাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষাকৃত অনেক নবীন ও যেহেতু আদালত কিছু বিধি-বিধান এবং পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয় সেহেতু উক্ত বিধি-বিধান এবং পদ্ধতি প্রয়োগে অনিচ্ছাকৃত ভুল হতেই পারে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল মঞ্জুর করে একদিন পর অর্থাৎ ১৫ মার্চ পূর্বাহ্নে আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে জামিন দেয়া হয়। নিয়মিত কার্যক্রমের আওতায় অভিযানটি পরিচালিত হয় যাতে আমার সামান্যতম কোন হস্তক্ষেপ ছিল না। কিন্তু আমাকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে এবং হস্তক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ করে নিষ্ঠুরভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। অভিযান পরিচালনাকালে যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কোন পদ্ধতিগত ভুল করেও থাকে সেটির দায়ভার কি সরাসরি আমার উপর বর্তায়? মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং সবার প্রতি বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।
কুড়িগ্রামের সম্মানিত সাংবাদিক ভাইয়েরা আমার আন্তরিক কার্যক্রম ও উদ্যোগের ফলে আমাকে সর্বদাই সাংবাদিক বান্ধব হিসেবে তুলে ধরেছেন অথচ বর্ণিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় আমাকে দোষী করে যে ভাবে একপাক্ষিকভাবে গত তিনদিন ধরে যে প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অসত্য ও অশালীন ভাষায় মন্তব্য করা হচ্ছে যা দেখে আমি বিষ্মিত, হতবাক। শুধু তাই নয় নতুন নতুন কৌশল সৃষ্টি করেও আমাকে হ্যারেজ করার চেষ্টা চলছে যে কারনে আমি মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত।
সম্মানিত কুড়িগ্রাম জেলাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাচ্ছি যে, জেলা প্রশাসক হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলায় যোগদানের পর থেকে আজ পর্যন্ত এ জেলার আর্থ-সামাজিক এবং মানবিক উন্নয়নে যেসব কাজ করেছি তার প্রত্যেকটি কাজেই প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক ভাইয়েরা আমার পাশে ছিলেন। সরকারের মাননীয় মন্ত্রী এবং উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মহোদয়গণের কুড়িগ্রাম জেলা সফরকালে এবং কুড়িগ্রামের উন্নয়নে অনুষ্ঠেয় বিভিন্ন সেমিনার, সমাবেশে করণীয় বিষয়ে এবং সার্বিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সাংবাদিকগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছি। অপরদিকে একজন জেলা প্রশাসক হিসাবে আমিও তাদের পেশাগত কাজে সর্বদা সহযোগিতা করেছি। সময়-অসময় বিবেচনায় না নিয়ে তাঁদের যেকোন আহ্বানে আমি তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়েছি। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সাংবাদিকগণের পারিবারিক সমস্যা সমাধানে, তাঁদের চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসা, সন্তানদের লেখাপড়া এমনকি কোন সাধারণ মানুষকে সংগে নিয়ে এসে আমাকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন মর্মে অনুরোধ করলেও তাদের সেই অনুরোধ বিভিন্নভাবে পজেটিভলি বিবেচনা করেছি। আমার উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে সন্তুষ্ট থেকে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দিয়েছেন। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, মানবিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং জেলা শহরের নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে সব কাজ করেছি, সাংবাদিক ভাইয়েরাসহ জেলার সাধারণ মানুষ স্বত:স্ফূর্তভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
২০১৮ সালে শেখ হাসিনা ধরলা সেতু এবং ২০১৯ সালে ১৬ অক্টোবর কুড়িগ্রাম জেলার আন্ত:নগর ট্রেন সার্ভিস ‘কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভিডিও কনফারেন্সে কুড়িগ্রাম জেলার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ, বর্তমান উন্নয়ন অগ্রগতি এবং এ জেলাবাসীর প্রয়োজন নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য প্রদানের পর এ জেলার সাধারণ জনগন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। কুড়িগ্রামে জেলা প্রশাসক হিসেবে সফল দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে পরপর দু’বার রংপুর বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক হিসাবে আমি নির্বাচিত হবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একই চিত্র দেখা গিয়েছে। একটি পরিত্যাক্ত পুকুর খনন বিষয়ে আমাকে বারবার দোষী করা হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের হাঁটার সুযোগ ও নান্দনিকতা বৃদ্ধি হয়েছে, আমি মনে করি এ বিষয়ে কুড়িগ্রামবাসী আমাকে চিরদিন মনে রাখবে। পুকুরটির চতুর দিকে ঘাস দ্বারা টার্ফিং করা হয়েছে সাধারণের হাটার জন্য হেরিং বন্ড রাস্তা এবং রাত্রি বেলায় পার্ক পুকুরটিকে আলোকি রাখার লক্ষ্যে ৫৬টি সোলার ল্যাম্প পোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। জনসাধারণের বসার জন্য সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চ বিভিন্ন প্রকার ফুলের গাছ এবং বাসকপাতা রোপন করা হয়েছে। দীর্ঘ দিনের ঝোঁপঝাড়ে পরিপূর্ণ পার্ক পুকুরটিকে সংস্কারের মাধ্যমে নেশা এবং অসামাজিক কার্যক্রমের আড্ডাস্থল থেকে সাধারণ মানুষের নির্মল বিনোদন কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সি মানুষ সকাল এবং সন্ধ্যায় হাঁটার জন্য পার্কপুকুরে আসেন।
বর্তমানে পার্কপুকুরের উত্তর দিকে একটি ভাওয়াইয়া মঞ্চ, পূর্ব দিকে একটি ঘাট এবং দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটি নান্দনিক গেইট তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এগুলো নির্মাণ সম্পন্ন হলে পার্কপুকুরটির আরো শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে এবং মানুষের নিকট আকর্ষণীয় একটি স্থান হিসেবে বিবেচিত হবে। সংস্কারকালে দুয়েক জন মানুষ পার্কপুকুরটি সুলতানা সরোবর নামে নামকরণের লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার পোস্ট দেয়। উক্ত পুকুরটি নিজের নামে নামকরণে আমার কখনই কোন খায়েশ ছিলনা কিংবা এখনও নেই। পুকুরটি পার্কপুকুর নামেই আছে। কিন্তু এই পুকুরটির নামকরণকে কেন্দ্র করে বিভিন্নভাবে প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে এবং আমাকে বার বার অপবাদ দেয়া হচ্ছে।
২০১৮ সালের ৩ মার্চ এ জেলায় যোগদানের পর থেকে জেলার সার্বিক আর্থ-সামজিক এবং মানবিক উন্নয়নে যে সব কর্মসূচি গ্রহণ করেছি এবং বাস্তবায়ন করেছি তার সুফল সাধারণ জনগন বর্তমানে ভোগ করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। গত দু’বছরে এ জেলার উন্নয়ন এবং নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছি একটি মাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা কখনো ধূলিস্মাৎ হতে পারে না। এ বিষয়ে সকলের সুবিবেচনা আশা করছি।
আমি রংপুর অঞ্চলের মানুষ হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলাকে নিজ জেলা হিসাবে বিবেচনা করে জেলার আর্থ-সামাজিক এবং মানবিক উন্নয়নে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি।
কুড়িগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক হিসাবে যোগদান করে এ জেলার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনুধাবন করি যে, কুড়িগ্রাম ১৬টি নদ-নদীময় সীমান্ত ঘেঁষা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ জেলা। প্রতিবছর বন্যা, নদীভাঙ্গন, বাল্যবিবাহ, শিক্ষার নিম্নহার, শিল্প কারখানা না থাকায় কর্মসংস্থানের অভাব, বিদেশ গমনে এ জেলার মানুষের অনীহার ফলে এ জেলার মানুষ আর্থ-সামাজিক কারণে উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে পিছিয়ে পড়েছে। লক্ষ্য করি যে, এ জেলার মানুষ পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান। প্রয়োজন সঠিক পথ প্রদর্শন।
এ জেলার হতাশাগ্রস্ত যুবদের চোখে স্বপ্ন বীজ বোনার প্রত্যয় নিয়ে, তাদেরকে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে, তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বিদ্যমান সুবিধা এবং সুবিধা প্রাপ্তির জন্য করণীয় বিষয়ে অবহিতকরণ এবং তাদেরকে মোটিভেশন প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করার লক্ষ্যে এ জেলায় যোগদানের পরপরই প্রতিষ্ঠা করি ‘স্বপ্নকুঁড়ি’ যার মূল কথা- স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখাই। স্বপ্নকুঁড়িতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মোটিভেশনের লক্ষে এক চমৎকার পরিবেশ। এই ‘স্বপ্নকুঁড়ি’র মাধ্যমে গত দু’বছরে প্রায় আট হাজার যুব এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে প্রশিক্ষণসহ উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে উঠতে মোটিভেশন প্রদান করা হয়েছে। যুব এবং যুব মহিলাদের বিদেশ গমনে ও আত্মকর্মী হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
যোগদানের পর থেকেই এ জেলার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে তাদেরকে আর্থ-সামাজিকভাবে কিছুটা হলেও এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্ভাবনী কর্মসূচি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। দারিদ্র বিমোচনে বাসকপাতা চাষ, ফুল চাষ, খাঁচায় মাছ চাষ, সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি পালন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি, ন্যাশনাল সার্ভিসের যুবদের পুনর্বাসন, ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন, জেলা শহরের নান্দনিকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদ্ম পুকুর, নিউটাউন পার্ক পুকুর সংস্কার, পার্ক পুকুরে নির্মানাধীন ভাওয়াইয়া মঞ্চ, জেলা প্রশাসকের চত্ত্বরে উন্মুক্তমঞ্চ ‘উদগীরণ’ নির্মাণ, গুণগত মানের নাগরিক সেবা নিশ্চিতরণে অভ্যর্থনা ও ই-সম্প্রসারণ কেন্দ্র-‘সেবাকানন’ স্থাপন, অভ্যাগতদের নিকট কুড়িগ্রাম জেলাকে একনজরে উপস্থাপনের লক্ষ্যে জেলা ব্র্যান্ডিং কর্ণার, জেলার প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের (২ লক্ষ ৪০ হাজার) শতভাগ রক্তের গ্রুপ নির্ণয় এবং নয় হাজার নয়শত বিরানব্বইটি ব্লাডক্লাব গঠন, কুড়িগ্রাম জেলাকে শতভাগ অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনকৃত প্রথম এবং একমাত্র স্কাউট জেলা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, ভবিষ্যত প্রজন্মের মানসপটে মুক্তিযোদ্ধাগণকে অম্লান করে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাগণ যে দুই হাতে অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করেছেন সেই দুই হাতের লাল রঙের স্পর্শের বাস্তব ছাপ, ছবি ও নিজ হাতের স্বাক্ষরসহ ৬টি সেটের ১৪২টি খণ্ডের ৫৬ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্টারি বীরগাঁথা তৈরি, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি, অন্যের উপর নির্ভরশীল না থেকে বিভিন্ন জাতীয় দিবস, উৎসবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্ব অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তা/কর্মচারী এবং তাদের সন্তানদের সমন্বয়ে সুষ্ঠু বিনোদন এবং সাংস্কৃতিক চর্চার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন শিল্পগোষ্ঠি ‘স্রোতোবহা’ অন্যতম। দাপ্তরিক কাজের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সনাতন ফাইলের পরিবর্তে চার রংয়ের ‘রং দেখে যায় চেনা’ ফাইলের পরিবর্তন করা হয়েছে। ফাইলের রং দেখেই সাধারণ, রাজস্ব এবং জুডিশিয়াল শাখার ফাইল সনাক্ত করা যায়। তাছাড়া মুজিববর্ষ ২০২০ উপলক্ষে জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় ২০২০টি করে বৃক্ষরোপন এবং একটি করে রাস্তার ‘মুজিব সড়ক’ নামকরণ করা হয়েছে।
বেকার যুবক এবং উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে খাঁচায় মাছ চাষে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। রৌমারী উপজেলার তাঁত শিল্পের বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে তাঁতে তৈরি উলেন চাদরের প্রমোশন করা হয়েছে। রমজান মাসে ইফতারের টাকা সাশ্রয় করে হতদরিদ্র পুরুষ ও মহিলাদের গরু, অটোরিকশা, সেলাই মেশিন, মুদি দোকানের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের অন্যতম একটি কাজ হচ্ছে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন; যাতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান একই কাজে উদ্বুদ্ধ হয়। রাজধানী ঢাকার সোহবানবাগে একজন অসুস্থ মা’র মাথায় পানি ঢালছে একটি ১০-১১ বছরের শিশু এবং তার বাড়ি কুড়িগ্রাম বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হলে সেই হতদরিদ্র পরিবারটিকে (ফরিদা ও আনসার) কুড়িগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সেই পরিবারটিকে খাসজমি বন্দোবস্ত দিয়ে বাড়ি করে দেয়া হয়েছে। একটি অটোরিকশা, একটি পুকুর এবং গরু প্রদান করা হয়েছে জীবিকা অর্জনের জন্য। ফরিদা এবং আনসারের ছেলে-মেয়েদেরকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে। হলোখানা ইউনিয়নের আলোচিত ভিক্ষুক দম্পত্তি আবদার-আরেচাকে জীবিকার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বসবাসের জন্য দুই রুমের একটি বাড়ি তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলায় স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে ফুলবাড়ি উপজেলার দাসিয়ারছড়ার ৮কিলোমিটার রাস্তার দু’ধারে জেলা প্রশাসন এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে বাসকপাতা চাষ করা হয়েছে। হতদরিদ্র নারীদের খণ্ডকালীন আয়ের উৎস সৃষ্টির গত বছর অক্টোবর মাসে প্রায় ২৫ হাজার বাসকচারা রোপণ করা হয়েছিল।
ডিসেম্বর ২০১৯ মাসে রোপিত বাসক থেকে উত্তোলিত পাতা একমি ফার্মাসিউটিক্যালসের নিকট বিক্রয় করে তালিকাভুক্ত নারীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বাসকপাতা থেকে সৃজিত খণ্ডকালীন আয়বর্ধক উৎসটি হতদরিদ্র নারীসহ যুবদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে স্বাবলম্বী হতে। তাছাড় কুড়িগ্রামের মাটি ও জলবায়ু ফুলচাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় বাসক চাষের সমসাময়িককালেই রাজারহাট উপজেলার ছিনাইহাট গ্রামে গত বছর ১৫ শতক জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে গাঁদা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ ফুলের চাষ করা হয়। ফুলচাষ লাভজনক হওয়ায় চলতি বছরে ফুলচাষের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। পাটেশ্বরীর আবু বক্কর সিদ্দিক তার সাত বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। হলোখানা সারডোবা গ্রামের চাষী নজরুল ইসলাম ভুট্টা আবাদ না করে নদী তীরবর্তী চরে ৬৫শতক জমিতে গাঁদা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ ফুলের চাষ করেছেন। ধীরেধীরে নতুন নতুন উদ্যোক্তাগণ ফুল চাষে এগিয়ে আসছে।
জেলা প্রশাসনের ইতিহাস দু’শ বছরের সমৃদ্ধ একটি ইতিহাস। শুরু থেকেই জেলা প্রশাসন মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আর মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসক কেন্দ্রীয় সরকারের একজন রিপ্রেজেনটেটিভ। জেলার বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমন্বয় করে মাঠ পর্যায়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে থাকেন জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন কোন ব্যক্তি নয়। একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। আমি মনে করি এ জেলায় যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতর এবং রাজনৈতিক ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে পরামর্শ করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জেলা এবং জেলাবাসীর জীবনমান উন্নয়নে যা কিছু করার দরকার তা সবই করার চেষ্টা করেছি। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত শিশুনিকেতন, কুড়িগ্রাম এ জেলার প্রাচীন একটি বিদ্যাপীঠ যা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরের পদক্ষেপ নিয়েছি। ভবন নির্মাণেরও বরাদ্দ এসেছে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু দিনের মধ্যেই ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে বিভিন্ন উপজেলায় মডেল মসজিদ ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
বঙ্গসোনাহাট স্থলবন্দরে স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইমিগ্রেশনের অনুমতি ইতোমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে। ইমিগ্রেশন চালু হলে দূরত্ব কমে আসবে। ফলে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে। বন্দরের কার্যক্রমে গতি আসবে। গত দু’বছর ধরে এ জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং মানবিক উন্নয়নে যেসব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি এবং গৃহীত কর্মপরিকল্পনার যতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি জেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেজে সাধারণ মানুষ তাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। আমি বিশ্বাস করি আমি আমার কর্মের মাধ্যমে এ জেলার অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা পেয়েছি। জেলা প্রশাসক হিসাবে যোগদানের ছয় মাসের মধ্যেই গত ২০১৮ সালে আমার বদলির আদেশ হলে তা প্রত্যাহারে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মানববন্ধন, সমাবেশে যে আবেগ এবং ভালবাসার প্রকাশ ঘটেছে তাতে সত্যিই আমি মুগ্ধ ও ধন্য। সাধারণ মানুষের এ অবদানে আমার কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পেয়েছিল বহুগুণ।
আমি সর্বদাই কুড়িগ্রামকে নিজ জেলা ভেবে জেলার উন্নয়নে আন্তরিকভাবে নিবেদিত থাকার চেষ্টা করেছি। গত দু’বছরে কুড়িগ্রাম জেলার সকল উপজেলায় বেশ কিছু উন্নয়নের/পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে যা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নিয়মিত কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত একটি মোবাইল কোর্টের কোনো ভুলকে কেন্দ্র করে সব অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে না। মোবাইল কোর্ট ভিন্ন একটি বিষয়। সুতরাং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই একে মূল্যায়ন করা উচিৎ।
সকল সাংবাদিক ভাই এবং কুড়িগ্রামের সকল মানুষের জন্য আমার আন্তরিক ভালোবাসা ছিল এবং চিরদিন থাকবে। আমার ও আমার পরিবারের জন্য সকলের জন্য সকলের নিকট দোয়া প্রার্থনা করছি। সবাই ভালো থাকবেন। অনিঃশেষ শুভকামনা।’
সুলতানা পারভীন