৫ জুন , বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বর্তমানে সারা বিশ্ব করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। আমরাতো দুরের কথা , দুনিয়ার উন্নত ,সভ্য , মোড়ল দেশ ও কুপোকাত হয়েছে। মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছেনা। দুনিয়ার মানুষ এখন ঘরবন্দি। সব প্রানী বাইরে , কেবল মানুষ বাইরে থাকতে পারছেনা। অস্ত্রপাতি কোন কাজে আসছেনা। প্রমান হয়েছে অস্ত্র মুল শক্তি নয় , শক্তি মানুষের স্বাস্থ্য। জনস্বাস্থ্যের উপর নজর দেওয়া জরুরী। কম্বোডিয়া , ভিয়েতনাম , কিউবা তা প্রমান করেছে। পৃথিবীর দেশ সমুহ তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনায় বিষয়টি বিবেচনায় রাখবে বলে আশা করা যায়। গত ৫ মাসে দুনিয়ার পরিবেশের একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের কারণে কলকারখানা যানবাহন , মানুষ পরিবেশের ক্ষতিকারক কোন কাজ করতে পারেনি। পাখীরা ফিরে এসেছে। গাছগুলি সতেজ হয়েছে। কার্বন নিঃস্বরণ বšধ হয়েছে। করোনা আমাদের পরিবেশের উন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে মনুষ্য প্রজাতিকে বাঁচাতে হলে , এই গ্রহটাকে মনুষ্য বসবাসের উপযোগী রাখতে পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে।
গত ৫ মাসে অনেকগুলো দিবস পার হয়ে গেল করেনাজনীত কারণে উদযাপন সম্ভব হয়নি। তাই বলে তার আবেদনতো শেষ হয়নি। করোনার জন্য আরো কত প্রান দিতে হবে তা জানিনা। তবে এক সময় করোনা নিয়ন্ত্রন হবে। হয়তো আবার অন্য কোন সমস্যা পৃথিবীতে আসবে। যাই আসুক সব বিষয় মেকাবেলা করতে প্রয়োজন জনস্বাস্থ্য , প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ। নিশ্চয় বিশ^বাসী তা বুঝবেন।
পরিবেশ মানব সভ্যতার এক গুরুত্ব¡পূর্ণ উপাদান । সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে পরিবেশ। মানুষের রচিত পরিবেশ তারই সভ্যতার বিবর্তনের ফসল। পরিবেশই প্রানের ধারক, জীবনী শক্তির যোগানদার। যুগে যুগে পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে প্রানীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপরেই তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। পরিবেশ প্রতিকুল হলে জীবনে ধংস ও সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী। পরিবেশের বিরুদ্ধতা বেঁচে থাকার পথকে অবলীলাক্রমে রুদ্ধ করে। পরিবেশের ওপর সম্পৃক্ত হয়ে মানুষ , অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রানী জীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে নিবিড় যোগসূত্র।
আমরা যে পরিবেশে বাস করি তা প্রতিমুহুর্তে দুষিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কলকারখানা ও যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। এগুলো বেশী পরিমানে বিষাক্ত বাস্প ও কার্বন মনোক্সাইড উৎপাদন করে বায়ু দুষনের কারন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি আমরা যে ভুমিতে বিচরন করি তাও ময়লা আবর্জনায় দুষিত। শিল্পবর্জ , বিষাক্ত রাষায়নিক পদার্থ ও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের মাধ্যমেও পানি দুষিত হয়। বন জঙ্গল ও গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে আর এভাবে পারিপার্শ্বিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা দুষন থেকে পুরাপুরি মুক্ত হতে না পারলেও এটি ব্যাপক অংশ কমাতে ও নিয়ন্ত্রন করতে পারি। এটি নিয়ন্ত্রন করতে আমাদেরকে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। । দুষন কমাতে বিভিন্ন ধরনের দুষন সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বেশী পরিমানে বৃক্ষরোপন বায়ু দুষন কমানোর পুর্বশর্ত এবং কার্যকর পয়:নিস্কাশন প্রনালী ও রক্ষনাবেক্ষন পানিদুষন অনেকাংশে কমাতে পারে। সর্বাগ্রে যানবাহন নিয়ন্ত্রন করা উচিৎ এবং রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট শব্দ সহনীয় মাত্রায় রাখা উচিৎ। সর্বোপরি প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে দুষন থেকে পরিবেশকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে।
একদিন মানুষ প্রকৃতিকে জয় করার নেশায় মেতেছিল। প্রকৃতিকে জয় করেও মানুষের সেই নেশার অবসান হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ জলে ও স্থলে মহাশূন্যে অধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তুু মানুষের এই বিজয় মানুষকে এক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আজ আমরা এক ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি। এ সংকট আজ বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের পরিবেশ আজ নানা ভাবে দূষিত । এই দূষন আজ ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই ভয়াবহ দিনের কথা স্মরন করেই আজ বিশ্বের মানুষ এগিয়ে এসেছে। ৫ জুন সেই বিশেষ দিন “বিশ্ব পরিবেশ দিবস”। এই দিন সব দেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় হওয়ার দিন।
ভয়াবহ পরিবেশ দুষনের কবলে পড়ে আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শঙ্কায় ধুকছে। অপেক্ষা করেছ এক মহাধ্বংসের আশংকা। আজ জলে বিষ, বাতাসে আতঙ্ক, মাটিতে মহাত্রাস। আজ বিগত ষাট বছরে ৭৬ টির বেশি প্রজাতির প্রানী নিশ্চিহ হয়ে গেছে। কয়েকশ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি
হচ্ছে বটে তবে এর পরিনামে বাতাসে প্রতিবছর ২০ কোটি টন কার্বন মনোক্সাইড সঞ্চিত হচ্ছে। বাযুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড গ্যাসের আনুপাতিক হার ক্রমশ বাড়ছে। তার ফলে বৃষ্টির জলে এসিডের পরিমান বেশি হচ্ছে। এই এসিড কার্বন অরন্যে মহামারীর সৃষ্টি করেছে। খাদ্যশস্যকে বিষাক্ত করেছে। দ্রæত গতিতে ধবংস হয়ে যাচ্ছে সবুজ অরন্য। সারা বিশ্বে বর্তমান মোট ৮০ শতাংশ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরন্যের প্রতি মিনিটে ২০ হেক্টর কৃষিযোগ্য জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর ৭০ লক্ষ হেক্টর জমি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। প্রতি মিনিটে ৪৫ হেক্টর উর্বর জমি বালুকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বাতাসে বিপুল পরিমান অক্সিজেন কমছে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারে ভূ-প্রকৃতির ওপর অত্যাচার বাড়ছেই। শস্য রক্ষার জন্য নানা ধরনের কীটনাশক ঔষুধ তৈরী ও অপরিকল্পিত প্রয়োগ হচ্ছে। জল, মাটি, বায়ু ছাড়াও আরও এক ধরনের দূষন আজ মানুষকে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। বর্তমান সভ্যতার এ এক অপ্রতিরোধ্য পরিনতি। শব্দদুষনের ক্ষতি ধীরে ধীরে ও অপ্রত্যক্ষভাবে ঘটে। শব্দদুষন শুধু শ্রমশক্তিকেই দুর্বল করেনা, মানুষের স্বাস্থ্যেরও প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। মাথা ধরা ক্লান্তি, অনিদ্রা ,ক্ষিধের অভাব বমির উদ্রেগ। এগুলোর অন্যতম কারন শব্দদুষন।
৫ জুন বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই প্রয়োজনীয় কর্মসূচী গ্রহন করে দিনটিকে সফল করে পরিবেশ দূষন থেকে মুক্তির নতুন উপায় উদ্ভাবনে ব্রতী হবে। সেখানে শুধু সরকারই নয়, দেশের অগনিত মানুষের সমবেত প্রয়াসেই সেই কর্মসূচী বাস্তবায়িত হবে। এভাবেই পুজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের প্রভাবে পৃথিবীর বুকে সমগ্র প্রানিজগতে যে ভয়াবহ বিপদের সুচনা হয়েছে, আজ যেই বিপদ মুক্তির প্রায়শ্চিত্ত করার সময় এসেছে । দেশে সরকার ও জনগন একসঙ্গে পরিবেশ রক্ষার কাজে হাত লাগিয়েছে । পরিবেশ দুষনের এই কারনগুলির জন্য বাংলাদেশ সহ ৩য় বিশ্বের মানুষ সবচে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ। অথচ পরিবেশ দুষনের কারনগুলির অধিকাংশের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। বাংলাদেশের সরকার প্রধান বিশ্ব জলবায়ু সন্মেলনে উচ্চকিত কন্ঠ। বাংলাদেশে পরিবেশ দুষণরোধে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওযা হয়েছে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ইটভাটা তৈরি করতে বিশেষ উচ্চতার চিমনি স্থাপন , নদী বা কারখানার দুষণ , ট্যানারী বর্জের দুষন রোধে ট্রিটম্যান্ট প্লান্ট স্থাপন,সকল প্রকার দুষন রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে উৎসাহিত করছে। সর্বশেষ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে করতে বর্তমান সময়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। যে কোন কলকারখানা স্থাপন করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামুলক করা হয়েছে।
পরিবেশের দুষন রোধে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ুর বিবর্তনে পরিবেশ দুষন নিয়ন্ত্রনে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে ক্ষতিপুরন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। তেমনি পরিবেশের উন্নয়নে গুরুত্বপুনৃ ভুমিকা ও অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী “চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ” পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষনে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশ নিজ দেশেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা , পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ , বৃক্ষরোপন, পরিবেশ বান্ধব নির্মান সামগ্রী উৎপাদন, পাঠ্যসুচিতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত করা , পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করা , পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনের ্ আওতায় এনে জরিমানা করা বা শাস্তি বিধান করা অন্যতম। এদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সকল উপাদান , ক্ষতিকারক বৃক্ষ না লাগানোর লক্ষ্যে প্রচারনা সব কিছুতেই সোচ্চার। এমনকি মসজিদের ইমাম রাজনীতিবীদ সকলেই্ পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এন জি ও ) পরিবেশ সংক্রান্ত কর্মসুচি রয়েছে। তারাও গ্রামীন জনগোষ্ঠিকে পরিবেশের উন্নয়ন , ভারসাম্য রক্ষার প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসুচি পালন করে থাকেন। আমাদের দেশে পরিবেশের উন্নয়নে এবং জনগোষ্ঠিকে সচেতন করার জন্য গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করছে প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়া। ফলে সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকার পরিবেশ বান্ধব। তারপরেও অসতেনতা নাই তা বলা যাবেনা। তাদের জন্য কাজ চলছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের ভুমিকা প্রশংসিত হচ্ছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ বসবাস করে। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশকে বসবাসের উপযোগি করতে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে সভ্যতা হুমকির সন্মুখীন হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য পরিবেশ উন্নয়নে যা কিছু করার দরকার তা নিশ্চিত করতে হবে । তবে সবচেয়ে জরুরী বিষয় হলো জনগণকে পরিবেশ সচেতন করার কোন বিকল্প নাই। আইন যেমন প্রনয়ন করতে হবে, তেমনি আইন মানার জন্য জনগণকে উৎসাহিত , অনুপ্রানিত , উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্ত করতে হবে, তবেই আগামীর বাংলাদেশ যেমন হবে বাসযোগ্য তেমনি আমরাও আমাদের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবো। আমার মাতৃভুমি প্রিয় বাংলাদেশ নিশ্চয় সেই লক্ষ্যে পৌছাবে এই আমাদেও প্রত্যাশা। করোনা কারণেই আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ মনুষ্য বসবাসের উপযোগী হচ্ছে। এই পরিবেশকে রক্ষা করেই আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা , জাতীয় বাজেট প্রনয়ন করতে হবে , মানুষকেও হতে হবে পরিবেশ সচেতন। কিশোর কবি সুকান্তের ভাষায় দুহাতে জঞ্জাল সরিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে যেতে হবে , বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই হোক অঙ্গীকার।