নিউজ ডেস্কঃ উত্তর কোরিয়ায় বিচারের পূর্বে বন্দিশালায় নির্যাতন, অপমান-অপদস্ত, অনাহারে রেখে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির সাবেক কর্মকর্তা এবং বন্দিদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে সোমবার (১৯ অক্টোবর) মানবাধিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এ তথ্য জানিয়েছে।
২০১১ সালে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন ক্ষমতা গ্রহণের পরের সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
২০১৪ সালে জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়ার ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দেশটির বিচার ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা নিয়ে বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে পদ্ধতিগত অচ্যাচার, অনাহারে রাখা এবং হত্যার নির্দেশ দেয়ার জন্য দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন এবং নিরাপত্তা প্রধানকে বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়। পিয়ংইয়ংয়ের এসব কর্মকাণ্ডকে নাৎসী যুগের নৃশংসতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। এইচআরডব্লিউ’র ৮৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে জাতিসংঘের অনুসন্ধানী তথ্য প্রমাণও সংযুক্ত করা হয়।
সাবেক ৮ কর্মকর্তা এবং ২২ জন বন্দির সাক্ষাতকার নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করে এইচআরডব্লিউ। তাদের একজন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটিকে জানান, তারা বন্দিদের সঙ্গে এমন আচরণ করে যেনো আটককৃতরা পশুর চেয়ে মূলহীন। অত্যাচারে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
এইচআরডব্লিউ’এর এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, উত্তর কোরিয়ার বিচারপূর্বক বন্দিশালা এবং তদন্ত পদ্ধতি বিধিবহির্ভুত, হিংস্র, নিষ্ঠুর এবং অবজ্ঞাপূর্ণ।
উত্তর কোরীয়োরা বলছেন, ‘বর্বর এ পদ্ধতির কারণে তারা সবসময় আতঙ্কে থাকেন। সেখানে যারা প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তাদের খেয়াল খুশিই সব। যাকে ইচ্ছে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং ঘুষ ছাড়া পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই।’ জানান এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া বিষয়ক পরিচালক।
এইচআরডব্লিউকে সাক্ষাতকার দেয়া সাবেক বন্দিরা জানান, প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা, কোন কোন দিন ১৩ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের কখনো হাঁটু গেড়ে, কোমড়ে হাত দিয়ে পায়ের উপর ভর করে, মাথা নিচু করে, ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হতো। কোন বন্দি নির্দেশ অমান্য করলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা তাদের বেদম প্রহার করতো। কখনো কখনো সবার উপর নেমে আসতো সম্মিলিত অত্যাচার।
চোরাকারবার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পালানোর চেষ্টার অপরাধে বেশ কয়েকবার আটক হন উত্তর কোরিয়ার সাবেক এক কর্মকর্তা। এইচআরডব্লিউকে তিনি জানান, শাস্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, পেটে এবং বাহুতে ব্যাপক মারধর।
তিনি আরো বলেন, যখন বন্দিশালায় ছিলাম, কিছু নিরাপত্তারক্ষী আমাদের চোখে, আঙুলে লাঠি দিয়ে, বন্দুক দিয়ে আঘাত করেছে। তাদের মেজাজ খারাপ থাকলে ভেতরে ঢুকে আমাদের পেটাতো। এটা প্রতিদিনকার ঘটনা। যখন আমাদের সেলে নির্যাতন বন্ধ থাকতো তখন পাশের সেলে অত্যাচার চলতো। যার কারণে সবসময় আতঙ্কে থাকতাম। একটা সময় জীবনের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম।
‘সীমাহীন যন্ত্রণা’
সাবেক এক নারী বন্দি জানান, স্থির হয়ে বসে থাকার নির্দেশ দেয়া আছে, এমন সময় কেউ অচেতনভাবে ঘুমিয়ে পড়লে, তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। উঠবস করানো হতে অন্তত ১ হাজার বার।
তিনি বলেন, আপনার কাছে মনে হতে পারে এটা অনেক বেশি। আপনি করতে পারবেন না। কিন্তু তারা তখন জোর খাটায় আপনি করতে বাধ্য। শরীরে এমন ব্যাথা হয়, মনে হবে আপনি মারা যাবেন, তারপরও আপনাকে তা করতে হয়।
৫০ বছর বয়সী সাবেক ব্যবসায়ী এ নারী জানান, এক তদন্তকারী তাকে ধর্ষণ করে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় এক পুলিশ কর্মকর্তাও তাকে যৌন হয়রানি করে।
সাক্ষাতকারে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বিচারপূর্ব প্রশ্নোত্তরপর্ব এবং জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম ধাপগুলোতে ব্যাপকহারে নির্যাতন, অত্যাচার করা হয়।
উত্তর কোরিয়া পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বিধি অনুযায়ী প্রহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু তদন্ত এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের সাক্ষ্য বা স্বীকারোক্তি আদায় করতে হয়। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বন্দিদের প্রহার করতে হয়। তখন লাঠি এবং বুট দিয়ে আঘাত করা হয়।
চোরাকারবারের দায়ে একলোক চারবার আটক হয়েছিলেন। তিনি এইচআরডব্লিউকে জানান, আমাকে এতো পরিমাণে প্রহার করা হয়েছিল যে, আমি বলতে বাধ্য হয়েছি, আমার ভুল হয়েছে।
ওই ব্যক্তির নাম কিম কেয়ুম চুল। তিনি জানিয়েছেন, কিভাবে ঘুষের মাধ্যমে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তদন্ত কর্মকর্তাকে তার বাবা ঘুষ দিয়ে কিভাবে শাস্তি কমিয়ে তিন মাসের মধ্যে তাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছিল।
সাক্ষাতকারে অংশ নেয়া প্রত্যেকে জানিয়েছেন, নিরাপত্তারক্ষী এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের চোখের দিকে তাকানোর অনুমতি নেই বন্দিদের। উত্তর কোরিয়ার সাবেক চার কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেন, বন্দিদের নামের পরিবর্তে নাম্বার দিয়ে চিহিৃত করা হয়। ওই নাম্বার ব্যবহার করে তাদের যাবতীয় কাজ চালানো হয়। দেশটির ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টি বন্দিদের ‘নিকৃষ্ট মানব’ হিসেবে বিবেচনা করে।
সাবেক বন্দিরা এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছেন, বন্দিশালার পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর, খুব সামান্য খাবার দেয়া হয়, অনেক বন্দিকে একসাথে গাদাগাদি করে থাকতে হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক মতো নেয়া যায় না, কম্বল, সাবান এবং নারীদের পিরিয়ড চলাকালীন ব্যবহার্য জিনিসপত্রও দেয়া হয় না।
সাবেক এক বন্দি জানান, তার কাছে প্রহার করা অপমান-অপদস্ত হওয়া এবং সব অনিশ্চিয়তার চেয়ে ভয়ংকর মনে হয়েছে অনাহারে থাকা। বলেন, বিশেষ করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতে তারা আপনাকে অভুক্ত রাখবে, যাতে আপনি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। আপনি শুধু বেঁচে থাকবেন। ক্ষুধায় আপনার মধ্যে আর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকবে না। পশুর মতো আচরণ করবেন।
সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তা একসময় বন্দিশালায় দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানকার পরিস্থিতিকে অসহনীয় বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। বলেন, বন্দিশালায় প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। কারো পক্ষে সেখানে ঘুমানো সম্ভব না। বন্দিশালা ত্যাগ করার পরপরই সবসময় আমাকে জামা কাপড় পরিবর্তন করে ফেলতো হতো। না হয়, লোকজন অভিযোগ করতো তোমার ইউনিফর্ম থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
এইচআরডব্লিউ জানায়, উত্তর কোরিয়ার উচিৎ বিচার পূর্ব প্রক্রিয়ায় অত্যাচার, অবজ্ঞা, অপমান-অপদস্ত করা বন্ধ করে বন্দিদের জন্য বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা, জামাকাপড়, পর্যাপ্ত আলো বাতাসে প্রয়োজনী থাকার জায়গার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।
অ্যাডামস বলেন, উত্তর কোরিয়ার উচিত পেশাদার পুলিশ বাহিনী এবং তদন্ত ব্যবস্থা গঠনে আন্তর্জাতিক সহায়তা নেয়া। যা অপরাধ সমাধানের জন্য নির্যাতনের পরিবর্তে প্রমাণের উপর নির্ভর করবে। অবসান হবে চলমান অন্ধকার যুগের।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে এর আগে জাতিসংঘে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত মানবাধিকার কাউন্সিলের ভাষণে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, নিজের কাজে মনযোগ দেন আপনারা।